দার্জিলিংয়ের পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিকাল পার্কে সম্প্রতি উদ্বোধন হয়েছে ভারতের প্রথম ‘ফ্রোজেন চিড়িয়াখানা’। এটি কেবল একটি সাধারণ চিড়িয়াখানা নয়, বরং হিমালয় অঞ্চলের বিরল ও বিপন্ন প্রাণীদের ডিএনএ সংরক্ষণের এক অনন্য উদ্যোগ। পর্যটকদের জন্য এটি একটি নতুন আকর্ষণ হিসেবে যুক্ত হয়েছে, যেখানে তারা প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের এই অসাধারণ মেলবন্ধনের সাক্ষী হতে পারবেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দার্জিলিং শুধু পর্যটনের ক্ষেত্রেই নয়, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণেও এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছে।
এই ‘ফ্রোজেন চিড়িয়াখানা’র উদ্বোধন হয়েছে ২০২৫ সালের মার্চ মাসে, যা পাহাড়ের রানী দার্জিলিংয়ের জন্য একটি গর্বের মুহূর্ত। পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিকাল পার্কে এই বিশেষ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো হিমালয়ের বৈচিত্র্যময় প্রাণীকুলের জিনগত উপাদান সংরক্ষণ করা। এখানে রেড পান্ডা, স্নো লিওপার্ড, হিমালয়ান ব্ল্যাক বেয়ার এবং অন্যান্য বিরল প্রজাতির প্রাণীদের ডিএনএ হিমায়িত অবস্থায় রাখা হবে। এই উদ্যোগের ফলে ভবিষ্যতে এই প্রাণীদের পুনরুৎপাদন বা গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংরক্ষিত থাকবে। পর্যটকরা এখানে এসে শুধু প্রাণীদের জীবন্ত রূপই দেখতে পাবেন না, বরং তাদের জিনগত ইতিহাস ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়া সম্পর্কেও জানতে পারবেন। এটি পর্যটনের পাশাপাশি শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতার একটি দারুণ সুযোগ।
বিস্তারিত জানতে গেলে বোঝা যায়, এই প্রকল্পটি দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও গবেষণার ফসল। পদ্মজা নাইডু চিড়িয়াখানা, যা ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, দীর্ঘদিন ধরে হিমালয়ের প্রাণীদের সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এই চিড়িয়াখানা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,১০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এবং ভারতের সবচেয়ে উঁচুতে থাকা চিড়িয়াখানা হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রায় ৬৭.৫৬ একর জমির উপর বিস্তৃত এই পার্কে বর্তমানে ২০০টিরও বেশি প্রাণী রয়েছে। ‘ফ্রোজেন চিড়িয়াখানা’র জন্য একটি আলাদা বিভাগ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাণীদের জিন সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় ক্রায়োপ্রিজারভেশন পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে, যার মাধ্যমে জিনগত উপাদান অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রায় হিমায়িত রাখা হয়।
এই প্রকল্পের পেছনে রয়েছে পরিবেশ সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার বৃহৎ লক্ষ্য। হিমালয় অঞ্চলের প্রাণীরা জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড় এবং মানুষের হস্তক্ষেপের কারণে ক্রমশ বিপন্ন হয়ে পড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, রেড পান্ডা, যিনি দার্জিলিংয়ের একটি প্রতীকী প্রাণী, তাদের সংখ্যা দিন দিন কমছে। এই ‘ফ্রোজেন চিড়িয়াখানা’র মাধ্যমে এই প্রাণীদের জিন সংরক্ষণ করে ভবিষ্যতে তাদের প্রজাতি পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা তৈরি করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এখানে পর্যটকদের জন্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও করা হয়েছে, যেখানে তারা এই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ সম্পর্কে জানতে পারবেন। এটি বিজ্ঞান ও প্রকৃতির এক অনন্য সংমিশ্রণ, যা দার্জিলিংকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে এখানে আরও কিছু সুবিধা যোগ করা হয়েছে। চিড়িয়াখানায় প্রবেশের টিকিট মূল্য সাধারণত ৬০ টাকা, তবে ‘ফ্রোজেন চিড়িয়াখানা’ বিভাগে প্রবেশের জন্য অতিরিক্ত ফি লাগতে পারে। এছাড়া, এখানে একটি ওয়াইল্ডলাইফ মিউজিয়াম রয়েছে, যেখানে হিমালয়ের প্রাণীদের জীবনচক্র ও তাদের পরিবেশ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। পর্যটকরা এখানে এসে স্নো লিওপার্ডের মতো বিরল প্রাণী দেখার পাশাপাশি তাদের জিন সংরক্ষণের গল্প শুনতে পারবেন। এটি শিশুদের জন্যও একটি শিক্ষামূলক স্থান হিসেবে কাজ করবে, যেখানে তারা প্রকৃতি রক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পারবে।
দার্জিলিংয়ের এই নতুন উদ্যোগ স্থানীয় অর্থনীতির জন্যও একটি বড় সুযোগ। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক দার্জিলিংয়ে আসেন কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য, টয় ট্রেন আর চা বাগান দেখতে। এখন ‘ফ্রোজেন চিড়িয়াখানা’ যুক্ত হওয়ায় পর্যটকদের ভিড় আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা, হোটেল মালিকরা এবং গাইডরা এই খবরে উৎফুল্ল। তবে এর সঙ্গে পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বও বেড়েছে। পর্যটকদের প্রতি অনুরোধ করা হয়েছে, তারা যেন চিড়িয়াখানা এলাকায় প্লাস্টিক ব্যবহার না করেন এবং প্রাণীদের বিরক্ত না করেন।
এই প্রকল্পটি শুধু দার্জিলিংয়ের জন্যই নয়, গোটা ভারতের জন্য একটি মাইলফলক। বিশ্বে এ ধরনের ‘ফ্রোজেন চিড়িয়াখানা’র ধারণা নতুন নয়, তবে ভারতে এটি প্রথম। এটি ভবিষ্যতে অন্যান্য অঞ্চলের জন্যও অনুকরণীয় হতে পারে। হিমালয়ের প্রাণীদের রক্ষা করার এই প্রচেষ্টা পর্যটকদের কাছে একটি নতুন অভিজ্ঞতা এনে দেবে, যেখানে তারা প্রকৃতির সৌন্দর্যের সঙ্গে বিজ্ঞানের অগ্রগতি দেখতে পাবেন।
সব মিলিয়ে, দার্জিলিংয়ের এই নতুন সংযোজন পর্যটনের মানচিত্রে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠেছে। প্রকৃতি প্রেমী, গবেষক এবং সাধারণ পর্যটক—সবার জন্যই এটি একটি বিশেষ আকর্ষণ। পরের বার দার্জিলিংয়ে গেলে শুধু চা আর পাহাড় নয়, এই ‘ফ্রোজেন চিড়িয়াখানা’ও আপনার তালিকায় থাকুক!