১০ বছরে দ্বিগুণ হল কোটিপতিদের সংখ্যা, বিশ্বে তৃতীয় স্থানে দেশ

ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে কোটিপতিদের সংখ্যা রেকর্ড হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, গত দশকে ভারতে মিলিয়নেয়ারদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে এবং দেশটি এখন বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ কোটিপতি…

Avatar

 

ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে কোটিপতিদের সংখ্যা রেকর্ড হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, গত দশকে ভারতে মিলিয়নেয়ারদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে এবং দেশটি এখন বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ কোটিপতি সংখ্যার দেশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। আর্থিক সংস্কার, প্রযুক্তিগত উন্নতি এবং উদ্যোক্তা বিকাশের ফলে ভারতের সম্পদ সৃষ্টির চিত্র আমূল পাল্টে গেছে।

আন্তর্জাতিক সম্পদ গবেষণা সংস্থা হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মধ্যে ভারতে প্রায় ৩ লক্ষ ২৬ হাজার ডলার মিলিয়নেয়ার রয়েছেন। এই সংখ্যা ২০১৩ সালের তুলনায় ৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধুমাত্র আমেরিকা ও চীনের পরেই ভারতের অবস্থান, যা দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তির প্রমাণ। গত পাঁচ বছরে এই বৃদ্ধির হার ছিল বার্ষিক ১২.২ শতাংশ, যা বিশ্বের অন্যান্য প্রধান অর্থনীতির তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।

ভারতের এই অর্থনৈতিক অগ্রগতির পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। প্রথমত, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে ভারতের আধিপত্য দেশটিকে বিশ্বের সফটওয়্যার রপ্তানির কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ব্যাঙ্গালোর, হায়দরাবাদ, পুনে এবং চেন্নাইয়ের মতো শহরগুলি প্রযুক্তি হাবে রূপান্তরিত হয়েছে, যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার স্টার্টআপ গড়ে উঠেছে। এই খাতে কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার ও উদ্যোক্তারা বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।

ডিজিটাল পেমেন্ট এবং ফিনটেক বিপ্লব ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামোতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পেটিএম, ফোনপে, গুগল পে-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলি গ্রামীণ এলাকা পর্যন্ত ডিজিটাল লেনদেনের বিস্তার ঘটিয়েছে। এই বিপ্লবের ফলে নতুন ব্যবসায়িক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং অসংখ্য তরুণ উদ্যোক্তা কোটিপতি হয়ে উঠেছেন। জিও প্ল্যাটফর্মের মতো টেলিকম কোম্পানিও এই ডিজিটাল বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

সরকারি নীতি ও সংস্কারের প্রভাব এই সম্পদ বৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৬ সালের পর থেকে জিএসটি (গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স) চালু, ব্যাংকিং সংস্কার এবং কর্পোরেট ট্যাক্স হার হ্রাসের মতো পদক্ষেপ ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করেছে। স্টার্টআপ ইন্ডিয়া, মেক ইন ইন্ডিয়া এবং ডিজিটাল ইন্ডিয়ার মতো প্রকল্পগুলি নতুন ব্যবসায়িক সুযোগ তৈরি করেছে। এর ফলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং নতুন ধনী শ্রেণির উত্থান ঘটেছে।

রিয়েল এস্টেট ও শেয়ারবাজারের অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি কোটিপতি সৃষ্টিতে বিশেষ অবদান রেখেছে। মুম্বাই, দিল্লি, ব্যাঙ্গালোরের মতো মেট্রো শহরগুলিতে সম্পত্তির দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের সেনসেক্স সূচক গত দশকে তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। এই বৃদ্ধির ফলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী এবং সম্পত্তির মালিকরা রাতারাতি কোটিপতি হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির আইপিও থেকে প্রাপ্ত মূলধন অনেক ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মচারীকে মিলিয়নেয়ার বানিয়েছে।

ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়িক পরিবারগুলিও এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থেকে উপকৃত হয়েছে। আম্বানি, আদানি, টাটা, বিড়লা, গোদরেজের মতো বিখ্যাত ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলি তাদের সম্পদ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। মুকেশ আম্বানির নেট ওয়ার্থ এখন ১০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি, যা তাকে এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের একজন করে তুলেছে। গৌতম আদানিও বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনী ব্যক্তির তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন।

শিক্ষাগত উন্নতি এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে ভারতের সাফল্য এই সম্পদ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আইআইটি, আইআইএম, আইআইএসসি-এর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসা গ্র্যাজুয়েটরা বিদেশে উচ্চ বেতনের চাকরি পেয়েছেন বা সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন। সিলিকন ভ্যালিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সিইওদের সংখ্যা এর প্রমাণ। সুন্দর পিচাই, সত্য নাদেলা, শান্তনু নারায়ণের মতো ব্যক্তিত্বরা বিশ্বব্যাপী ভারতীয় প্রতিভার পরিচয় তুলে ধরেছেন।

কৃষি ও উৎপাদন ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। কৃষি প্রযুক্তি, জৈব চাষাবাদ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে নতুন উদ্যোক্তারা সফল হয়েছেন। বিশেষ করে, দুগ্ধ শিল্প, মুরগি পালন এবং মৎস্য চাষে অনেকে লক্ষাধিক টাকা আয় করছেন। সরকারের কৃষক উৎপাদক সংগঠনের (এফপিও) মাধ্যমে কৃষকরা সরাসরি বাজারে পৌঁছানোর সুযোগ পাচ্ছেন।

ই-কমার্স বিপ্লব ভারতের খুচরা ব্যবসায়ার মানচিত্র পাল্টে দিয়েছে। ফ্লিপকার্ট, আমাজন ইন্ডিয়া, স্ন্যাপডিলের মতো প্ল্যাটফর্মগুলি লক্ষ লক্ষ ছোট ব্যবসায়ীকে দেশব্যাপী গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ দিয়েছে। অনলাইন মার্কেটপ্লেসে সফল বিক্রেতারা বছরে কোটি টাকা আয় করছেন। বিশেষ করে, হস্তশিল্প, বস্ত্র এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর বিক্রেতারা এই সুবিধা পেয়েছেন।

আর্থিক সেবা খাতে ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়েছে। ব্যাংকিং, বীমা, মিউচুয়াল ফান্ড এবং স্টক ব্রোকারেজ সেবায় নতুন কোম্পানিগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জেরোধা, গ্রো, আপস্টক্সের মতো অ্যাপ ভিত্তিক ব্রোকারেজ কোম্পানি লক্ষ লক্ষ নতুন বিনিয়োগকারী তৈরি করেছে। এসআইপি (সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান) এর মাধ্যমে মধ্যবিত্ত পরিবারও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছে।

স্বাস্থ্যসেবা ও ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে ভারতের বিশ্বব্যাপী খ্যাতি দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রেখেছে। কোভিড মহামারী চলাকালে ভারতের ভ্যাকসিন উৎপাদন ক্ষমতা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে। সিরাম ইনস্টিটিউট, বায়োকন, রেডডি’স ল্যাবের মতো কোম্পানিগুলি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আছে। এই খাতে কর্মরত বিজ্ঞানী ও উদ্যোক্তারাও কোটিপতি হয়েছেন।

ভৌগোলিকভাবে দেখলে, মুম্বাই, দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর, হায়দরাবাদ, পুনে এবং চেন্নাইয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক কোটিপতি বাস করেন। তবে টিয়ার-২ ও টিয়ার-৩ শহরগুলিতেও এই সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। কোচি, ইন্দোর, লখনউ, ভুবনেশ্বর, বিশাখাপত্তনমের মতো শহরগুলিতে নতুন ব্যবসায়িক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। আঞ্চলিক ভাষায় ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি এবং স্থানীয় পণ্যের ব্র্যান্ডিং নতুন সম্পদ সৃষ্টির পথ খুলে দিয়েছে।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতীয় কোটিপতিদের আচরণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা রিয়েল এস্টেট, শেয়ারবাজার এবং সোনার পাশাপাশি আধুনিক বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছেন। ক্রিপ্টোকারেন্সি, স্টার্টআপ ফান্ডিং, আর্ট কালেকশন এবং বিলাসবহুল সম্পদে তাদের আগ্রহ বাড়ছে। প্রাইভেট ইক্যুইটি ও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আয়বৈষম্য একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়। যেখানে কোটিপতিদের সংখ্যা বাড়ছে, সেখানে গ্রামীণ এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠী এই অগ্রগতির সুফল সমানভাবে পাচ্ছে না। সরকারি নীতিনির্ধারকরা এই বৈষম্য কমানোর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি চালু করেছে। কিন্তু এখনও এক্ষেত্রে অনেক কাজ বাকি।

ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে দেখা যায়, ভারতের কোটিপতি সংখ্যা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী দশকে এই সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, পরিচ্ছন্ন শক্তি, বায়োটেকনোলজি এবং স্পেস টেকনোলজির মতো নতুন খাতগুলি পরবর্তী প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করবে। ভারত সরকারের জাতীয় হাইড্রোজেন মিশন, সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং এবং স্পেস প্রোগ্রামের বিস্তার নতুন ব্যবসায়িক সুযোগ সৃষ্টি করবে।

দেশের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি অভ্যন্তরীণ বাজারের আকার বাড়াচ্ছে। এর ফলে ভোগ্যপণ্য, বিনোদন, পর্যটন এবং শিক্ষা খাতে নতুন ব্যবসায়িক সুযোগ তৈরি হচ্ছে। ভারতের তরুণ জনগোষ্ঠী, যাদের গড় বয়স ২৮ বছর, এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে।

About Author
Avatar

আমাদের স্টাফ রিপোর্টারগণ সর্বদা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন যাতে আপনি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পেতে পারেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রতিশ্রুতি আমাদের ওয়েবসাইটকে একটি বিশ্বস্ত তথ্যের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।তারা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ে বিশ্বাসী, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন তৈরিতে সক্ষম