ভারতের বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (র)-এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক স্তরে বিতর্ক তীব্র হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ) সম্প্রতি র-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশ করেছে। অভিযোগ, শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের লক্ষ্য করে হত্যাচেষ্টার পেছনে এই সংস্থার সম্পৃক্ততা রয়েছে। তবে, ভারত সরকার এসব অভিযোগকে ‘অমূলক’ ও ‘পূর্বধারণাপ্রসূত’ বলে আখ্যা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কমিশনটির বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য ও হামলা বেড়েছে। শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা গুরপতওয়ান্ত সিং পাননুনকে হত্যার ষড়যন্ত্রে র-এর একাধিক সদস্যের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়েছে। পাননুন যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার নাগরিক এবং শিখস ফর জাস্টিসের প্রধান আইন উপদেষ্টা। গত নভেম্বরে নিউইয়র্কে তাকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ফাঁস করে দেয়। ম্যানহাটনের আদালতে দায়ের করা অভিযোগপত্রে র-এর প্রাক্তন কর্মী বিকাশ যাদবকে প্রধান অভিযুক্ত করা হয়েছে।
এছাড়াও, ২০২৩ সালের জুনে কানাডার সুরেতে শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার গুলিতে নিহত হন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সরাসরি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সূত্রমতে, এই দুটি ঘটনাই র-এর ‘ক্রসবর্ডার অপারেশনের’ অংশ। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে দুই ভারতীয় গোয়েন্দাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল গোপন প্রতিরক্ষা তথ্য চুরির অভিযোগে।
প্রেক্ষাপট ও র-এর ভূমিকা
১৯৬৮ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে র প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান ও চীনকে প্রতিহত করতে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো ছিল এর মূল লক্ষ্য। সময়ের সাথে সাথে সংস্থাটি দক্ষিণ এশিয়ার বাইরেও সক্রিয় হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতকে সমর্থন দেওয়া, ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফের ফোনালাপ রেকর্ড করা, ১৯৮৮ সালে মালদ্বীপে অপারেশন ক্যাকটাসের মাধ্যমে সরকার পুনরুদ্ধার—এসব সফল মিশনে র-এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
তবে, প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে র প্রায়ই বিতর্কের কেন্দ্রে। শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা ২০১৮ সালে দাবি করেছিলেন, র তার জীবননাশের চক্রান্ত করেছিল। নেপাল ও পাকিস্তান সরকারও বিভিন্ন সময়ে র-এর হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভারতের অবস্থান
ইউএসসিআইআরএফ-এর সুপারিশ আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক নয়। বিশ্লেষকদের মতে, চীনকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের কৌশলগত গুরুত্ব থাকায় এই সুপারিশ বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কম। গত কয়েক বছরে কোয়াড জোটের মাধ্যমে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে, ওয়াশিংটন আনুষ্ঠানিকভাবে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার চেয়ে কূটনৈতিক চাপ বাড়ানোর পথই বেছে নিতে পারে।
ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় এই অভিযোগগুলিকে ‘অযৌক্তিক’ আখ্যা দিয়ে বলেছে, জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত যেকোনো ইস্যুতে তারা মার্কিন কর্তৃপক্ষের সাথে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করছে। পাননুন মামলার তদন্তের জন্য গঠিত উচ্চস্তরের কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে দিল্লি।
শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদ: একটি জটিল ইস্যু
১৯৮০-এর দশকে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন রক্তাক্ত রূপ নেয়। সময়ের সাথে সাথে দেশের অভ্যন্তরে এই আন্দোলন দুর্বল হলেও, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেনের মতো দেশে কিছু শিখ গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। ভারত সরকারের মতে, পাননুন ও নিজ্জার মতো নেতারা খালিস্তান আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করতে বিদেশি মদতপুষ্ট গুপ্তহত্যা ও সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছেন।
গোয়েন্দা তৎপরতার নতুন মাত্রা
বিশেষজ্ঞদের মতে, নরেন্দ্র মোদি সরকারের আমলে র-এর অপারেশনাল সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বৈদেশিক গোয়েন্দা কার্যক্রমে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং কূটনৈতিক স্তরে সমর্থন এর প্রধান কারণ। তবে, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ সংস্থাটির ভাবমূর্তিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাব্য প্রভাব
এই বিতর্ক ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। গোয়েন্দা সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন সতর্কতা আসতে পারে। অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বিস্তার রোধে র-এর ভূমিকা পশ্চিমা দেশগুলোর কাছেই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ থেকে যাবে বলে অনুমান।
এই ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক আইন, সার্বভৌমত্ব এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সীমারেখা নিয়ে নতুন বিতর্কের সূত্রপাত করেছে। ভারতে র-এর ক্রিয়াকলাপ নিয়ে অভ্যন্তরীণ সমালোচনাও বাড়ছে। সংস্থাটির তৎপরতা কীভাবে দেশের বৈদেশিক নীতিকে প্রভাবিত করছে, তা নিয়ে সংসদীয় স্তরেও আলোচনার দাবি উঠতে শুরু করেছে।
র-এর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলি ভারতের জন্য একটি জটিল কূটনৈতিক পরীক্ষা তৈরি করেছে। একদিকে, জাতীয় নিরাপত্তার নামে সক্রিয় গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া; অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা—এই দ্বৈত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে দিল্লিকে। ভবিষ্যতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জবাবদিহিতা নিয়ে বৈশ্বিক স্তরে আলোচনা আরও তীব্র হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।