ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে দুই প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব – ইন্দিরা গান্ধী এবং নরেন্দ্র মোদী – তাদের নেতৃত্বের শৈলী এবং নির্বাচনী সাফল্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য প্রদর্শন করেছেন। যদিও তারা দুই ভিন্ন যুগে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের রাজনৈতিক প্রভাব এবং জনপ্রিয়তার মধ্যে বেশ কিছু সমান্তরাল দিক রয়েছে।
ইন্দিরা গান্ধী ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এবং পুনরায় ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা জওহরলাল নেহেরুর কন্যা হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। অন্যদিকে, নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি দীর্ঘদিন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ করার পর জাতীয় রাজনীতিতে উত্থান ঘটান।
ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের নির্বাচনে “গরিবি হটাও” স্লোগান নিয়ে ব্যাপক জনসমর্থন পান। এই নির্বাচনে কংগ্রেস দল লোকসভায় ৩৫২টি আসন লাভ করে। এছাড়া ১৯৮০ সালের নির্বাচনেও তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। অন্যদিকে, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ২০১৪ সালের নির্বাচনে ২৮২টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি আরও শক্তিশালী হয়ে ৩০৩টি আসন লাভ করে।
ইন্দিরা গান্ধীর “গরিবি হটাও” স্লোগান ভারতের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তিনি ব্যাংক জাতীয়করণ, রাজকীয় ভাতা বাতিল এবং কৃষি সংস্কারের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যা তাঁকে “গরিবের মা” হিসেবে খ্যাতি এনে দেয়। মোদীর ক্ষেত্রে, তাঁর “সবকা সাথ, সবকা বিকাশ” (সবার সাথে, সবার উন্নয়ন) স্লোগান জনপ্রিয় হয়। তিনি “স্বচ্ছ ভারত অভিযান”, “জন ধন যোজনা”, “উজ্জ্বলা যোজনা” এর মতো প্রকল্পগুলি বাস্তবায়ন করেন, যা তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে।
ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ লক্ষ্য করা যায়। তিনি দলের মধ্যে এবং সরকারে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করেন। এমনকি রাজ্যগুলিতে মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রেও তাঁর প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য। মোদী সরকারের ক্ষেত্রেও একই ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং রাজ্যগুলির স্বায়ত্তশাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জিএসটি বাস্তবায়ন, জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল এর উদাহরণ।
ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে বিরোধী দলগুলি ছিল বিভক্ত এবং দুর্বল। ১৯৭১ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কোনো শক্তিশালী জোট গড়ে উঠেনি। মোদী যুগেও অনুরূপ পরিস্থিতি দেখা যায়। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলগুলি একটি কার্যকর জোট গঠনে ব্যর্থ হয়। জাতীয় পর্যায়ে কংগ্রেসের দুর্বলতা এবং আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে ঐক্যের অভাব বিজেপির সুবিধা করে দিয়েছে।
ইন্দিরা গান্ধী জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের একজন প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মোদীর কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলি বেশ ভিন্ন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইসরায়েল এবং অস্ট্রেলিয়ার সাথে সম্পর্ক জোরদার করেছেন। একই সময়ে, তিনি রাশিয়ার সাথে ঐতিহ্যগত বন্ধুত্ব বজায় রেখেছেন এবং চীনের সাথে সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন।
ইন্দিরা গান্ধীর অর্থনৈতিক দর্শন ছিল মূলত সমাজতান্ত্রিক। তিনি ব্যাংক জাতীয়করণ, শিল্প নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন এবং বিদেশী বিনিয়োগের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। এর বিপরীতে, মোদী সরকার উদারনৈতিক অর্থনীতির পক্ষপাতী। তিনি “মেক ইন ইন্ডিয়া”, “স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া” এর মতো প্রকল্প চালু করেছেন যা বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং ব্যবসা সহজীকরণের লক্ষ্যে পরিচালিত।
ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন, যা ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি বিতর্কিত অধ্যায়। এই সময় নাগরিক অধিকার সীমিত করা হয় এবং বিরোধী নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। মোদি সরকারের আমলে দুটি বড় সিদ্ধান্ত – ২০১৬ সালের নোটবন্দি এবং ২০২০ সালের কোভিড-১৯ লকডাউন – জনজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এই সিদ্ধান্তগুলি নিয়ে যেমন সমর্থন ছিল, তেমনি সমালোচনাও হয়েছে।
ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে গণমাধ্যম ছিল সীমিত এবং অনেকাংশে সরকার নিয়ন্ত্রিত। বেতার এবং দূরদর্শন ছিল তথ্য প্রচারের প্রধান মাধ্যম। জরুরি অবস্থার সময় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সীমিত করা হয়। মোদী যুগে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। ফেসবুক, টুইটার, ওয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্মগুলি রাজনৈতিক প্রচারণা এবং জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মোদি নিজেও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে দক্ষ এবং এর মাধ্যমে জনগণের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখেন।
ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগগুলি ছিল জরুরি অবস্থার সময় গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং নেপোটিজম। ১৯৭৫-৭৭ সালের জরুরি অবস্থা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায়। মোদি সরকারের বিরুদ্ধে প্রধান সমালোচনাগুলি হল সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে উদ্বেগ, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রভাব (যেমন নোটবন্দি), এবং সরকারি সংস্থাগুলির স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন। জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়েও বিতর্ক হয়েছে।
উভয় নেতার শাসনকালে কৃষক আন্দোলন একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে ১৯৭০-এর দশকে কৃষক আন্দোলন হয়েছিল, যা সবুজ বিপ্লবের পটভূমিতে ঘটেছিল। মোদি সরকারের সময়ে ২০২০-২০২১ সালে কৃষি আইন নিয়ে বড় আকারের কৃষক আন্দোলন হয়, যা শেষ পর্যন্ত সরকারকে আইনগুলি প্রত্যাহার করতে বাধ্য করে।
ধর্মীয় রাজনীতি উভয় নেতার সময়েই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং পাঞ্জাবে সন্ত্রাসবাদ একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। ১৯৮৪ সালে অপারেশন ব্লু স্টার এবং পরবর্তীতে তাঁর হত্যাকাণ্ড এই সংকটের চরম পরিণতি। মোদির নেতৃত্বে বিজেপি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে, যা তাঁর জনপ্রিয়তার একটি প্রধান উৎস কিন্তু একই সময়ে সমালোচনারও কারণ।
নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে উভয় নেতাই উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছেন। ইন্দিরা গান্ধী নিজেই ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একটি মাইলফলক স্থাপন করেন। তিনি নারী শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে গুরুত্ব দেন। মোদি সরকার “বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও” প্রকল্প চালু করেছে এবং তিন তালাক নিষিদ্ধ করে মুসলিম নারীদের অধিকার সুরক্ষার চেষ্টা করেছে।
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে দুই নেতার দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য রয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে সচেতনতা কম ছিল, তবে তিনি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেন। মোদি সরকার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে এবং নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে গুরুত্ব দিয়েছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে উভয় নেতাই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছেন। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে ১৯৬৮ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি গৃহীত হয়, যা শিক্ষার কাঠামোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনে। মোদি সরকার ২০২০ সালে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে, যা শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কারের লক্ষ্য নিয়েছে।
ইন্দিরা গান্ধী এবং নরেন্দ্র মোদী, দুই ভিন্ন যুগের এই দুই নেতা, তাদের নেতৃত্বের শৈলী এবং প্রভাবের ক্ষেত্রে অনেক সাদৃশ্য প্রদর্শন করেছেন। উভয়েই শক্তিশালী কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, জনপ্রিয় কল্যাণমূলক নীতি, এবং বলিষ্ঠ আন্তর্জাতিক অবস্থানের মাধ্যমে ভারতীয় রাজনীতিতে গভীর ছাপ রেখেছেন। তবে তাদের মধ্যে পার্থক্যও রয়েছে, বিশেষত অর্থনৈতিক দর্শন এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে। এই দুই নেতার তুলনামূলক বিশ্লেষণ ভারতীয় গণতন্ত্রের ক্রমবিকাশ এবং দেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপের পরিবর্তনকে বুঝতে সাহায্য করে।