Inquilab Zindabad slogan origin: আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে হঠাৎ করে “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” স্লোগানটি এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল কেন? বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের গণঅভ্যুত্থানের পর এই স্লোগানটি তরুণদের মুখে মুখে ফিরছে। কিন্তু এই ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানের আসল অর্থ কী? কোথা থেকে এসেছে এই বিপ্লবী উচ্চারণ? আজকের এই পোস্টে আমরা জানবো এই ঐতিহাসিক স্লোগানের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস, এর গভীর অর্থ এবং কেন এটি আজও প্রাসঙ্গিক। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক এই চমকপ্রদ যাত্রা।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানের মূল অর্থ কী?
ইনকিলাব জিন্দাবাদ একটি উর্দু-ফারসি শব্দগুচ্ছ যার বাংলা অনুবাদ হলো “বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক” বা “বিপ্লব চিরজীবী হোক”। এই স্লোগানটি মূলত দুটি অংশে বিভক্ত – ইনকিলাব এবং জিন্দাবাদ।
শব্দের ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ
ইনকিলাব শব্দটি এসেছে মূলত আরবি ‘ইকলাব’ শব্দ থেকে, যার অর্থ পরিবর্তন বা বিপ্লব। অন্যদিকে জিন্দাবাদ হলো উর্দু ও ফারসি ভাষার মিশ্রণ, যার অর্থ দীর্ঘজীবী হোক বা অভিনন্দন জানানো।
প্রখ্যাত ভারতীয় ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিবের মতে, ইনকিলাব জিন্দাবাদের সম্পূর্ণ অর্থ দাঁড়ায় “বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক”। তবে সাধারণ অর্থে এটি পরিবর্তনকে অভিনন্দন জানানো বা বিপ্লবকে সমর্থন জানানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
ইতিহাসের পাতায় ইনকিলাব জিন্দাবাদের জন্ম
এই বিখ্যাত স্লোগানটির জন্মকাহিনী অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ১৯২১ সালে প্রথমবারের মতো এই স্লোগানটি উচ্চারণ করেন মাওলানা হাসরাত মোহানি। তিনি ছিলেন একাধারে একজন ইসলামিক পণ্ডিত, উর্দু কবি, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
মাওলানা হাসরাত মোহানির অবদান
হাসরাত মোহানি ভারতের উত্তর প্রদেশের উন্নাও জেলার মোহন নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম ছিল ফজলুল হাসান, কিন্তু ‘হাসরাত’ ছিল তার কলমি নাম যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক পরিচয়েও ব্যবহৃত হতো।
তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রথম পূর্ণ স্বরাজ বা পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনে ভারতবর্ষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ হিসেবে তিনি ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটি প্রথম ব্যবহার করেন।
ভগত সিংয়ের মাধ্যমে জনপ্রিয়করণ
যদিও হাসরাত মোহানি এই স্লোগানের জনক, কিন্তু এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় বিপ্লবী ভগত সিংয়ের কণ্ঠে। ১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসে ভগত সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত যখন দিল্লির কেন্দ্রীয় আইনসভায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটান, তখন তারা ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দেন।
পরবর্তীতে ১৯২৯ সালের জুনে দিল্লির হাইকোর্টে তাদের যৌথ বিবৃতিতেও এই স্লোগানটি উচ্চারিত হয়। সেই থেকে এটি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি অগ্নিমন্ত্র হয়ে ওঠে।
উপমহাদেশে ইনকিলাব জিন্দাবাদের বিস্তার
ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই স্লোগানটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রথমদিকে যদিও ব্রিটিশ রাজে বামপন্থী কমিউনিস্টরা এই স্লোগানটি ব্যবহার করতেন, পরবর্তীতে এটি বিভিন্ন মতাদর্শিক পটভূমির মানুষদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রভাব
এই স্লোগানটি হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের অফিসিয়াল স্লোগান ছিল। এটি কমিউনিস্ট কনসোলিডেশন এবং অল ইন্ডিয়া আজাদ মুসলিম কনফারেন্সেরও স্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনৈতিক উপন্যাসগুলোতে প্রায়শই স্বাধীনতাকামী চরিত্রদের এই স্লোগান দিতে দেখানো হয়েছে। এটি প্রতিরোধ, বিপ্লব এবং ন্যায়বিচারের কালজয়ী প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
আধুনিক রাজনীতিতে ব্যবহার
আজও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি এই ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান ব্যবহার করে। পাকিস্তানে বামপন্থী ও মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে এই স্লোগান শোনা যায়। ভারতে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ও জাতিভেদ বিরোধী বিক্ষোভে এই স্লোগান ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশে ইনকিলাব জিন্দাবাদের আগমন
বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবে এই স্লোগানের ব্যবহার সীমিত ছিল। তবে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা অতীতে এই স্লোগান দিতে শোনা যেত। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই মাসে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যখন ছাত্র-জনতার আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে, তখন তরুণরা ব্যাপকভাবে এই স্লোগানটি ব্যবহার করতে শুরু করে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির গ্রহণ
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা তাদের আত্মপ্রকাশী অনুষ্ঠানে ব্যাপকভাবে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান ব্যবহার করেন। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ প্রায় সব শীর্ষ নেতা তাদের বক্তব্যের শেষে এই স্লোগানটি দিয়ে থামেন।
তবে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব স্পষ্ট করে বলেছেন যে এটি তাদের আনুষ্ঠানিক দলীয় স্লোগান নয়। তার ভাষায়, “যেহেতু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটি বেশ আলোচিত ছিল, তারই ধারাবাহিকতায় এখনো আমরা এই স্লোগানটি বিভিন্ন কর্মসূচিতে ব্যবহার করছি।”
সামাজিক প্রভাব ও আলোচনা
এই স্লোগানটি নিয়ে বাংলাদেশে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ মনে করেন যে যারা বাইরে থেকে অতিমাত্রায় ভারত বিরোধিতা দেখায়, তারা আসলে ভারতীয় বিপ্লবী স্লোগান দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। এটি একটি বিরোধাভাস হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অন্যদিকে, লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, “তাঁদের মতে ৫ আগস্ট যদি একটি বিপ্লব হয়, সে বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক—সেই সেন্সে এ স্লোগান ঠিক আছে।”
আধুনিক যুগে ইনকিলাব জিন্দাবাদের প্রাসঙ্গিকতা
একটি শতবর্ষেরও বেশি পুরনো স্লোগান আজও কেন এত জনপ্রিয় এবং প্রাসঙ্গিক? এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের বুঝতে হবে যে বিপ্লব বা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা কোনো নির্দিষ্ট সময়ে সীমাবদ্ধ নয়। যতদিন অন্যায়, অসাম্য ও শোষণ থাকবে, ততদিন ইনকিলাব জিন্দাবাদের মতো স্লোগান মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা করেছে। এই পরিবর্তনকে টিকিয়ে রাখার জন্য, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এবং একটি ন্যায্য সমাজ গড়ার জন্য তরুণরা এই স্লোগানটিকে তাদের আদর্শের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছে।
তবে এটাও মনে রাখা দরকার যে স্লোগান দিয়েই সব সমস্যার সমাধান হয় না। প্রকৃত পরিবর্তনের জন্য চাই সুস্পষ্ট কর্মসূচি, সুশাসন এবং জনগণের কল্যাণে কাজ করার মানসিকতা।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ শুধুমাত্র একটি স্লোগান নয়, এটি একটি চেতনা। যে চেতনা বলে দেয় যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, পরিবর্তনের জন্য আওয়াজ তোলা এবং একটি ভালো সমাজের স্বপন দেখা মানুষের চিরকালীন অধিকার। আজকের বাংলাদেশেও এই স্লোগানটি সেই একই বার্তা দিচ্ছে – বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, পরিবর্তন এগিয়ে চলুক।
আশা করি এই পোস্টটি পড়ে আপনি ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ও অর্থ সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। এই তথ্যগুলো আপনার কাছে কেমন লাগলো, কমেন্টে জানান। আর এই পোস্টটি যদি আপনার উপকারে এসে থাকে, তাহলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না।