সিজারের পর আবার কবে থেকে সহবাস? জানুন সঠিক সময় ও বিশেষজ্ঞের মতামত

সিজারিয়ান বা সি-সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্মের পর দম্পতিদের মনে অন্যতম প্রধান প্রশ্ন থাকে, "সিজারের কতদিন পর সহবাস করা নিরাপদ?" এটি এমন একটি প্রশ্ন যা নিয়ে অনেকেই খোলাখুলি আলোচনা করতে দ্বিধা…

Debolina Roy

 

সিজারিয়ান বা সি-সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্মের পর দম্পতিদের মনে অন্যতম প্রধান প্রশ্ন থাকে, “সিজারের কতদিন পর সহবাস করা নিরাপদ?” এটি এমন একটি প্রশ্ন যা নিয়ে অনেকেই খোলাখুলি আলোচনা করতে দ্বিধা বোধ করেন, অথচ এর সাথে জড়িয়ে আছে মায়ের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে সিজারিয়ান ডেলিভারি এখন একটি সাধারণ প্রক্রিয়া হলেও, এটি একটি বড় অস্ত্রোপচার। তাই এরপর শরীরকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

এই নিবন্ধে আমরা সিজারের পর সহবাসের সঠিক সময়, শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি, সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক যৌন জীবনে ফিরে আসার জন্য প্রয়োজনীয় সকল তথ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

সহবাসের জন্য কেন অপেক্ষা প্রয়োজন?

সিজারিয়ান অপারেশনের সময় পেটের এবং জরায়ুর একাধিক স্তর কাটা হয়। এই কাটা স্থানগুলো সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে যেতে এবং শরীরকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে নির্দিষ্ট সময় লাগে। চিকিৎসকরা সাধারণত সি-সেকশনের পর ৬ সপ্তাহ বা প্রায় দেড় মাস অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন। এই সময়কালকে পোস্টপার্টাম পিরিয়ড বা প্রসব পরবর্তী সময় বলা হয়। এই অপেক্ষার পেছনে একাধিক বৈজ্ঞানিক এবং শারীরিক কারণ রয়েছে:

  • জরায়ুর নিরাময়: সি-সেকশনের সময় জরায়ুর যে অংশে কাটা হয়, সেই ক্ষতস্থানটি পুরোপুরিভাবে সারতে সময় লাগে। এই সময়ের আগে সহবাস করলে জরায়ুতে সংক্রমণ (infection) বা রক্তপাতের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
  • সার্ভিক্স বা জরায়ুমুখ বন্ধ হওয়া: গর্ভধারণের সময় জরায়ুমুখ প্রসারিত হয় এবং প্রসবের পর এটি ধীরে ধীরে তার আগের আকারে ফিরে আসে ও বন্ধ হয়। এই প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হতেও প্রায় ৬ সপ্তাহ সময় লাগে। জরায়ুমুখ পুরোপুরি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত সহবাস করলে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হতে পারে।
  • অস্ত্রোপচারের ক্ষতের যত্ন: পেটের বাইরের সেলাই শুকিয়ে গেলেও ভেতরের স্তরগুলো সারতে আরও বেশি সময় নেয়। সহবাসের সময় অসাবধানতাবশত পেটে চাপ লাগলে ভেতরের সেলাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা থেকে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
  • লকিয়া বা প্রসব পরবর্তী রক্তস্রাব: প্রসবের পর প্রায় ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত যোনিপথ দিয়ে যে রক্ত এবং শ্লেষ্মা নির্গত হয়, তাকে লকিয়া বলে। এই স্রাব পুরোপুরি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত সহবাস থেকে বিরত থাকা উচিত, কারণ এটি সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।

পরিসংখ্যান কী বলছে?

বিশ্বজুড়ে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সন্তান জন্মের পর মায়েদের যৌন জীবনে ফিরতে সময় লাগে। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রায় ৮৩% মহিলা প্রসবের প্রথম তিন মাসের মধ্যে যৌন সংক্রান্ত কোনো না কোনো সমস্যার সম্মুখীন হন। যদিও সিজারিয়ান ডেলিভারির ক্ষেত্রে যোনিপথে কোনো আঘাত লাগে না, তবুও অস্ত্রোপচারের ধকল, ক্লান্তি এবং হরমোনের পরিবর্তন যৌন ইচ্ছাকে প্রভাবিত করে।

কখন বুঝবেন আপনি শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত?

চিকিৎসকের দেওয়া ৬ সপ্তাহের সময়সীমা একটি সাধারণ নির্দেশিকা মাত্র। বাস্তবে, প্রত্যেক মায়ের সেরে ওঠার প্রক্রিয়া ভিন্ন। তাই সময়সীমার পাশাপাশি নিজের শরীরের সংকেত বোঝা অত্যন্ত জরুরি।

শারীরিক প্রস্তুতি:

  • ব্যথামুক্ত থাকা: আপনার সিজারের কাটা স্থান এবং পেটে কোনো ব্যথা থাকা উচিত নয়।
  • রক্তস্রাব বন্ধ হওয়া: লকিয়া বা প্রসব পরবর্তী রক্তস্রাব সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।
  • শক্তি ফিরে পাওয়া: নতুন শিশুর যত্ন এবং অস্ত্রোপচারের পর শরীর অত্যন্ত ক্লান্ত থাকে। নিজেকে যথেষ্ট শক্তিশালী এবং প্রাণবন্ত মনে করলে, তবেই এগোনো উচিত।
  • চিকিৎসকের সবুজ সংকেত: ৬ সপ্তাহ পর চিকিৎসকের কাছে পোস্টপার্টাম চেক-আপের জন্য যান। তিনিই আপনার শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে সহবাসের জন্য আপনি প্রস্তুত কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন।

মানসিক প্রস্তুতি:

শারীরিক সুস্থতার মতোই মানসিক প্রস্তুতিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় মায়েরা শারীরিক দিক থেকে সুস্থ হলেও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন না।

  • যৌন ইচ্ছা ফিরে আসা: হরমোনের পরিবর্তন, স্তন্যপান করানো, ঘুমের অভাব এবং নতুন দায়িত্বের চাপে যৌন ইচ্ছা কমে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। নিজের উপর জোর করবেন না।
  • উদ্বেগ ও ভয়: সহবাসের সময় ব্যথা লাগতে পারে বা সেলাই খুলে যেতে পারে, এই ভয় অনেক মায়ের মনে কাজ করে। এই ভয় কাটিয়ে ওঠা জরুরি।
  • আত্মবিশ্বাস: গর্ভাবস্থা এবং সিজারের পর শারীরিক গঠনে অনেক পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনগুলো নিয়ে হীনমন্যতায় না ভুগে, নিজের শরীরকে গ্রহণ করা এবং আত্মবিশ্বাসী হওয়া প্রয়োজন।
  • পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন: অনেক মা প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতায় ভোগেন, যা তাদের যৌন জীবনের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। যদি অতিরিক্ত মন খারাপ, কান্না বা হতাশা অনুভব করেন, তবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।

ধীরে ধীরে শুরু করুন: কিছু জরুরি টিপস

যখন আপনি এবং আপনার সঙ্গী উভয়েই প্রস্তুত, তখন কিছু বিষয় মাথায় রাখলে পুনরায় সহবাসের অভিজ্ঞতা মসৃণ এবং আনন্দদায়ক হতে পারে।

  • খোলামেলা আলোচনা: আপনার ভয়, উদ্বেগ এবং প্রত্যাশা নিয়ে সঙ্গীর সাথে কথা বলুন। তারও উচিত আপনাকে বোঝা এবং সহযোগিতা করা।
  • সঠিক পজিশন: এমন যৌন অবস্থান বেছে নিন যেখানে আপনার পেটের কাটা স্থানে কোনো চাপ পড়বে না। যেমন, পাশে ফিরে বা আপনি উপরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এমন কোনো পজিশন চেষ্টা করতে পারেন।
  • লুব্রিকেন্টের ব্যবহার: প্রসবের পর এবং স্তন্যপান করানোর সময় ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কমে যাওয়ায় যোনিপথ শুষ্ক থাকতে পারে। এর ফলে সহবাস কষ্টকর হতে পারে। এই সমস্যা এড়াতে ওয়াটার-বেসড লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করুন।
  • ফোরপ্লে-তে সময় দিন: সরাসরি সহবাসের পরিবর্তে ফোরপ্লে বা অন্তরঙ্গ মুহূর্ত উপভোগের মাধ্যমে শুরু করুন। এটি আপনাকে মানসিকভাবে স্বচ্ছন্দ হতে সাহায্য করবে।
  • ব্যথা হলে থামুন: যদি সামান্যতম ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব করেন, তাহলে সাথে সাথে বিরতি দিন এবং সঙ্গীকে জানান। জোর করে কিছু করার চেষ্টা করবেন না।

জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি

একটি সাধারণ ভুল ধারণা হলো, স্তন্যপান করালে গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এটি সম্পূর্ণ সত্যি নয়। সিজারের পর শরীরকে পরবর্তী গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত হতে কমপক্ষে ১৮ মাস সময় দেওয়া উচিত। তাই, পুনরায় সহবাস শুরু করার সাথে সাথেই একটি নির্ভরযোগ্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বেছে নেওয়ার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)

১. সিজারের কতদিন পর আমি ভারী কাজ করতে পারব?

সাধারণত, সিজারের পর ৬-৮ সপ্তাহ পর্যন্ত ভারী কাজ (যেমন, বালতি তোলা, আসবাবপত্র সরানো) এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে, হালকা হাঁটাচলা প্রথম থেকেই শুরু করা যেতে পারে।

২. সিজারের সেলাই শুকাতে কতদিন সময় লাগে?

বাইরের সেলাই সাধারণত ৭-১০ দিনের মধ্যে শুকিয়ে যায় এবং কাটা হয় বা ত্বকের সাথে মিশে যায়। কিন্তু ভেতরের স্তরগুলো সম্পূর্ণ সারতে ৬ সপ্তাহ বা তার বেশি সময় লাগতে পারে।

৩. সহবাসের সময় ব্যথা হলে কী করব?

ব্যথা হলে সঙ্গে সঙ্গে থেমে যান। কয়েকদিন অপেক্ষা করে আবার চেষ্টা করতে পারেন। যদি ব্যথা持续 থাকে, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন। এটি কোনো সংক্রমণ বা অন্য সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।

৪. সিজারের পর কি নরমাল ডেলিভারি সম্ভব?

হ্যাঁ, অনেক ক্ষেত্রে সিজারের পর নরমাল ডেলিভারি সম্ভব, যাকে ভ্যাজাইনাল বার্থ আফটার সিজারিয়ান (VBAC) বলা হয়। তবে এটি বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে এবং এর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।

সিজারের পর সহবাস একটি সংবেদনশীল বিষয়। এর জন্য কোনো তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়। প্রতিটি মায়ের শরীর এবং সেরে ওঠার গতি আলাদা। তাই, নিজের শরীরকে সময় দিন, তার কথা শুনুন এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হওয়ার পরেই এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিন। সঙ্গীর সাথে খোলামেলা আলোচনা এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ আপনার এই নতুন যাত্রাকে আরও সুন্দর এবং নিরাপদ করে তুলবে।

About Author
Debolina Roy

দেবলীনা রায় একজন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক, যিনি স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে পাঠকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত। ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করা দেবলীনা তার লেখায় চিকিৎসা বিষয়ক জটিল তথ্যগুলি সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেন, যা সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য এবং উপকারী। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, এবং রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান এবং প্রাঞ্জল লেখনী পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দেবলীনা রায়ের লক্ষ্য হল সঠিক ও তথ্যনির্ভর স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করা এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।