বাড়ির আঙিনায় থাকা কুনো ব্যাঙকে আমরা আপদ মনে করে তাড়িয়ে দেই, অথচ এই সাধারণ প্রাণীটিই ভূমিকম্পের আগাম সংকেত দিতে পারে। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে কুনো ব্যাঙ ভূমিকম্প হওয়ার কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগে থেকেই বিশেষ আচরণ শুরু করে এবং নিজেদের আবাসস্থল ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। যুক্তরাজ্যের ওপেন ইউনিভার্সিটির প্রাণীবিদ ড. রাসেল গ্রান্টের গবেষণায় এই আশ্চর্যজনক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, যা ভূমিকম্প পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলতে পারে।
কুনো ব্যাঙ বুফোনিডি প্রজাতির অন্তর্গত, যা এশিয়ান কমন টোড নামেও পরিচিত। এরা মূলত বাংলাদেশ, ভারত এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। মূলত পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে এই প্রাণীরা। শরীরে আচিলের মত ছোট ছোট দাগের কারণে এদের সহজেই চেনা যায়।
গবেষক ড. রাসেল গ্রান্ট, যিনি ব্যাঙ নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করেন, তিনি ইতালির একটি লেকে কুনো ব্যাঙদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে এই অবিশ্বাস্য বিষয়টি আবিষ্কার করেন। তার গবেষণা শুরু করার মাত্র ২৯ দিনের মাথায় সেই লেক এলাকায় ৬.৩ মাত্রার একটি প্রবল ভূমিকম্প হয়। পরবর্তীতে তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি দেখেন যে, ভূমিকম্পের ঠিক ৬-৭ দিন আগে থেকেই কুনো ব্যাঙগুলো অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেছিল।
আশ্চর্যজনকভাবে, ভূমিকম্পের ৫ দিন আগে ব্যাঙগুলো নিজেদের আবাসস্থল ছাড়তে শুরু করে। তারপর আরও তিন দিন পর, তারা সম্পূর্ণভাবে গবেষণাস্থল সান রুফফিনো লেকের আশপাশ থেকে অন্য জায়গায় চলে যায়। শুধু সাধারণ ব্যাঙগুলোই নয়, পোয়াতি ব্যাঙগুলোও নিরাপদ স্থানে চলে যায়, যা বিষয়টিকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে। আর ব্যাঙগুলো আবাসস্থল ছাড়ার ঠিক ৩ দিন পরেই ঐ এলাকায় ৬.৩ মাত্রার প্রবল ভূমিকম্প হয়, যাতে আবরুৎসো অঞ্চলে লাকিলা শহর ও সংলগ্ন এলাকায় শতাধিক মানুষ মারা যায়
কুনো ব্যাঙের এই আচরণ কেবল ভূমিকম্পের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। ড. গ্রান্ট জানিয়েছেন, ঝড় কিংবা বৃষ্টির পূর্বাভাসে কুনো ব্যাঙগুলো এমন আচরণ করে না, অর্থাৎ তারা নিজেদের আবাসস্থল ছেড়ে অন্যত্র চলে যায় না। এই ঘটনা কেবলমাত্র ভূমিকম্পের আগে দেখা যায়।
এটা আরও লক্ষণীয় যে, ভূমিকম্পের পর কুনো ব্যাঙগুলো আবার তাদের আবাসস্থলে ফিরে আসে। গবেষক গ্রান্ট জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের ৬-৭ দিন পরে, যখন পরবর্তী ছোটখাটো ভূমিকম্পের সম্ভাবনা কমে যায়, তখন তার গবেষণায় চিহ্নিত ব্যাঙগুলো আবার তাদের পূর্বের আবাসস্থলে ফিরে আসে।
বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না কীভাবে কুনো ব্যাঙ ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পায়। ড. গ্রান্টের মতে, কুনো ব্যাঙের দেহে এক ধরনের বিশেষ সেন্সর রয়েছে, যা তাদেরকে ভূমিকম্পের আগাম সংকেত ধরতে সাহায্য করে। প্রকৃতি তাদেরকে দিয়েছে এই অসাধারণ ক্ষমতা। এই বিষয়ে আরও বিস্তৃত গবেষণা চালিয়ে যেতে চান বিজ্ঞানীরা।
ভূমিকম্প একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যার কারণে প্রতি বছর শত শত মানুষ মারা যায় এবং বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সম্পদহানি হয়। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করার চেষ্টা করলেও এখনও পর্যন্ত তেমন সাফল্য পাননি। কিন্তু প্রকৃতি যে সমাধান দিয়েছে কুনো ব্যাঙের মাধ্যমে, তা বিশেষভাবে গবেষণার দাবি রাখে।
কুনো ব্যাঙের জীবনযাত্রা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানলে আমরা দেখতে পাই, এরা আকারে মাত্র কুড়ি সেন্টিমিটারের এবং ওজন ১৫ থেকে ২০ গ্রাম। শীতকালে এরা শীতনিদ্রায় (হাইবারনেশন) চলে যায় এবং একটানা ছয় মাস পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকতে পারে। বর্ষাকালে প্রজনন মরশুমে স্ত্রী ব্যাঙ প্রায় ৩০,০০০ ডিম্বাণু ছাড়ে।
প্রাণীজগতে ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়া কেবল কুনো ব্যাঙয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ভূমিকম্পের ঠিক আগে আগে দেখা যায় মাছেরা পানির মধ্যে ছোটাছুটি করতে থাকে, সাপেরা গর্তের মধ্যে কুঁকড়ে যায়। এসব প্রাণীদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করেও ভূমিকম্পের আগাম সংকেত পাওয়া যেতে পারে।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা (International Union for Conservation of Nature) কুনো ব্যাঙকে ‘least concern’ বা ন্যূনতম উদ্বেগের প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করেছে। তবে পরিবেশ দূষণ ও বাসস্থান হারানোর কারণে ভবিষ্যতে এদের সংখ্যা কমে যেতে পারে।
সহজ কথায় বলতে গেলে, প্রকৃতি আমাদের চারপাশে এমন অনেক সংকেত রেখেছে, যা আমরা ঠিকভাবে পড়তে পারলে অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি। কুনো ব্যাঙয়ের এই অসাধারণ ক্ষমতা প্রমাণ করে যে, প্রকৃতি আমাদের ভাবনার চেয়েও অনেক বেশি জটিল ও রহস্যময়। মানুষের তৈরি প্রযুক্তির চেয়েও প্রাকৃতিক সেন্সরগুলো কখনও কখনও অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে। তাই যে কুনো ব্যাঙকে আমরা আপদ মনে করে তাড়িয়ে দেই, সেই প্রাণীই আমাদের জীবন রক্ষা করতে পারে।