তাজিকিস্তানের হিসোর সেন্ট্রাল স্টেডিয়ামে ইরানের বিরুদ্ধে গোলশূন্য প্রথমার্ধের পর ভারতের স্বপ্ন ভেঙে যায় দ্বিতীয়ার্ধেই। কাফা নেশনস কাপের দ্বিতীয় ম্যাচে সোমবার (১ সেপ্টেম্বর ২০২৫) নতুন কোচ খালিদ জামিলের নেতৃত্বে ভারতীয় দল ৩-০ গোলে হেরেছে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ২০তম স্থানাধিকারী ইরানের কাছে। ১৩৩তম স্থানের ভারতের বিপরীতে ১১৩ ধাপ এগিয়ে থাকা এই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রথমার্ধে দুর্দান্ত রক্ষণের পর দ্বিতীয়ার্ধে ৬০, ৮৯ ও ৯৩ মিনিটে গোল খেয়ে পরাজিত হয় ব্লু টাইগার্স।
ইরান ও ভারতের মধ্যে এটিই দশম সাক্ষাৎ এবং ভারতের শেষ জয় এসেছিল ১৯৫৯ সালে এরনাকুলামে। সেই ম্যাচে চুনী গোস্বামী, ইউসুফ খান ও তুলসী বালারামের গোলে ৩-১ গোলে জিতেছিল ভারত। এরপর থেকে সব সময়ই ইরানের আধিপত্য রয়েছে এই দুই দেশের সাক্ষাতে। মোট দশ ম্যাচের মধ্যে ভারত জিতেছে মাত্র একবার, আট ম্যাচে এগিয়ে ইরান এবং একটি ম্যাচ ড্র হয়েছে।
খালিদ জামিলের যুগের শুরু হয়েছিল তাজিকিস্তানকে ২-১ গোলে হারিয়ে। আনোয়ার আলি ও সন্দেশ ঝিঙ্ঘানের গোলে সেই জয় পেয়ে আত্মবিশ্বাস বেড়েছিল ভারতীয় দলের। কিন্তু ইরানের মতো শক্তিধর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সেই আত্মবিশ্বাসের কঠিন পরীক্ষা নিল এই ম্যাচ।
গোটা প্রথমার্ধ জুড়ে ভারতীয় দল ‘পার্ক দ্য বাস’ কৌশল ব্যবহার করে রক্ষণভাগে ভিড় জমিয়ে রাখে। খালিদ জামিল প্রকৃতপক্ষে ৭-২-১ ফর্মেশনে দল সাজিয়েছিলেন, যেখানে শুধু ইরফান ইদওয়াদ আক্রমণে ছিলেন। মাঝমাঠে সুরেশ সিং ও দানিশ ফারুকরা মূলত রক্ষণ সামলানোর কাজেই ব্যস্ত ছিলেন, আশিক কুরুনিয়ান ও বিক্রম প্রতাপ সিং দুই পার্শ্বে থাকলেও কার্যত সাইড ব্যাকের ভূমিকা পালন করেছেন।
ম্যাচের গোড়ার দিকেই ইরানের চাপ শুরু হয়। ৫ম মিনিটে গুরপ্রীত সিং সান্ধুর জোরালো সেভ দিয়ে শুরু হয় ভারতের প্রতিরক্ষা। এরপর একের পর এক কর্নার আসতে থাকে ইরানের পক্ষে, কিন্তু ভারতের রক্ষণভাগ সেগুলো সামলে নেয়। প্রথমার্ধে মোট আট বার কর্নার পেয়েছিল ইরান।
সন্দেশ ঝিঙ্ঘান ও আনোয়ার আলি প্রতিটি আক্রমণ প্রতিহত করেছেন দুর্দান্তভাবে। গোলকিপার গুরপ্রীত সিং সান্ধু কয়েকটি জোরালো শটও সেভ করেন। ১৭ মিনিটে ইরানের হাজেমনেহজাদের একক চেষ্টা গুরপ্রীতের দুর্দান্ত সেভে রুখে যায়।
দ্বিতীয়ার্ধ শুরুর পর পরই খালিদ জামিল দুটি বদল করেন। জিকসন সিং ও চিংলেনসানা সিংকে নামিয়ে ৫-৪-১ ফর্মেশনে যান তিনি। কিন্তু এই বদলই কাল হয়ে দাঁড়ায় ভারতের জন্য। নতুন খেলোয়াড়রা ম্যাচের গতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার আগেই ৫৯ মিনিটে গোল হজম করে ভারত।
কানানি জাদেগানের তোলা দুর্দান্ত সেন্টার অনুমান করতে পারেনি ভারতীয় ডিফেন্ডাররা। রাহুল ভেকে বল ক্লিয়ার করার সুযোগ পেলেও তার মুহূর্তের ভুলে বল দিক পরিবর্তন করে এক গজ দূর থেকে গোল করেন আমির হোসেইন হোসেইনজাদে।
প্রথম গোল খাওয়ার পর ভারতীয় দল কিছুটা তেড়েফুঁড়ে আক্রমণ করার চেষ্টা করলেও গোলের মুখ খুলতে পারেনি। খালিদ জামিল ৬৮ মিনিটে আরও তিনটি বদল করেন – জিতিন এমএস, নাওরেম মহেশ সিং ও মানভীর সিং নামান। এতে খেলায় কিছুটা ছন্দ ফেরে ভারতের।
কিন্তু গোল খাওয়ার পর আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে ইরান। ৭৩ মিনিটে মেহেদি তারেমি ও আলিরেজা জাহানবকশকে নামায় তারা। এই দুই বিকল্প খেলোয়াড়ের প্রভাব পড়ে সাথে সাথেই।
৮৯ মিনিটে দ্বিতীয় গোলের দেখা পায় ইরান। তারেমি ভারতীয় ডিফেন্ডারদের টেনে এনে জাহানবকশের কাছে বল পাস করেন। জাহানবকশের শট গুরপ্রীত সেভ করলেও ফিরতি বল গোলবারে ধাক্কা লেগে আলি আলিপোরঘারার কাছে চলে যায়, যিনি সহজেই গোল করেন।
সংযোজিত সময়ে (৯৩ মিনিট) শেষ পেরেকটি পুঁতে দেন তারেমি। জাহানবকশের পাস পেয়ে সুন্দর ফিনিশে তৃতীয় গোল করেন ইন্টার মিলানের প্রাক্তন স্ট্রাইকার। ৩-০ গোলে জিতে মাঠ ছাড়ে ইরান।
এই পরাজয়ের পরও খালিদ জামিলের কৌশল ও দলের লড়াকু মনোভাবের প্রশংসা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ১১৩ ধাপ এগিয়ে থাকা দলের বিরুদ্ধে প্রথমার্ধ গোলশূন্যে রাখা এবং ৬০ মিনিট পর্যন্ত টিকে থাকা কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়। বিশেষত যখন ইরানের প্রথম একাদশেই মেহেদি তারেমি, জাহানবকশের মতো তারকা ছিলেন না।
ভারতের বিরুদ্ধে ইরানের এই জয় খুবই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু যেভাবে ভারতীয় দল লড়াই করেছে, বিশেষত প্রথমার্ধে, তা নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। খালিদ জামিলের হাতে মাত্র কয়েক দিনের ট্রেনিং নিয়ে এই পারফরম্যান্স ভবিষ্যতের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে।
কাফা নেশনস কাপে এখন ভারতের শেষ ম্যাচ ৪ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে। এই ম্যাচে জিতলে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে খেলার সুযোগ পাবে ভারত। কারণ ইরান সম্ভবত তাজিকিস্তানকে হারিয়ে গ্রুপ বিজয়ী হবে এবং ফাইনালে পৌঁছাবে।
ভারতীয় ফুটবলের জন্য এই ম্যাচের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অক্টোবর মাসে সিঙ্গাপোরের বিরুদ্ধে এএফসি এশিয়ান কাপ কোয়ালিফায়ার প্রস্তুতি। ৯ ও ১৪ অক্টোবর সিঙ্গাপোরের বিরুদ্ধে এই দুই ম্যাচ ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পরপর তৃতীয়বারের মতো এশিয়ান কাপে যাওয়ার স্বপ্ন রয়েছে তাদের।
খালিদ জামিলের এই প্রথম পরাজয় হলেও তার দলের সামগ্রিক পারফরম্যান্স আশাব্যঞ্জক। বিশেষত যখন ভারতীয় ফুটবল দল বাংলাদেশ, আফগানিস্তানের বিরুদ্ধেও সম্প্রতি জিততে ব্যর্থ হয়েছিল। কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে বিদেশি কোচ আনার পর অবশেষে একজন দেশীয় কোচের হাতে দল পেয়েছে নতুন দিক।
আগামী ম্যাচগুলোতে এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আরও ভালো ফলাফলের প্রত্যাশা রাখা যায় ভারতীয় ফুটবল থেকে। ইরানের মতো প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যে মানসিক দৃঢ়তা ও সংগঠিত ফুটবল দেখিয়েছে ভারত, তা নিশ্চিতভাবে আশার সঞ্চার করে।