গত ১২ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘বিজয়ের’ দাবি করে ইরান ভারতের জনগণ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছে। নয়াদিল্লিতে ইরানের দূতাবাস বুধবার এক বিবৃতিতে ভারতের নাগরিক, রাজনৈতিক দল, সংসদ সদস্য, বেসরকারি সংস্থা, ধর্মীয় নেতা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়েছে যারা এই সংকটকালে তেহরানের পাশে ‘দৃঢ়ভাবে এবং সোচ্চারে’ দাঁড়িয়েছিলেন।
ইরানি দূতাবাসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “জায়নবাদী শাসন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসনের মুখে ইরানি জাতির বিজয়ের অনুষ্ঠানে, নয়াদিল্লিতে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের দূতাবাস ভারতের সকল মহৎ ও স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে”। দূতাবাস বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে যে এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন উপায়ে ইরানের মহান জাতির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে গত ১৩ জুন যখন ইসরায়েল ইরানের সামরিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে ব্যাপক হামলা চালায়। এই হামলায় ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্র এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কারখানাগুলো লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল, যা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইরানও পাল্টা আক্রমণ চালায় ইসরায়েলি শহরগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার মাধ্যমে।
যুদ্ধের তীব্রতা আরও বেড়ে যায় যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ নামে একটি সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ইরানের তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্রে বোমা হামলা চালায়। ফোরদো, নাতানজ এবং ইসফাহানের এই পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলা বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ সৃষ্টি করে। ইরানি দূতাবাস এই হামলাকে “জাতিসংঘ সনদ, মানবিক নীতিমালা এবং আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক নিয়মকানুনের গুরুতর লঙ্ঘন” বলে নিন্দা জানিয়েছে।
১২ দিনের এই যুদ্ধে উভয় পক্ষের উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইরানের বিপ্লবী গার্ডের প্রধান হোসেইন সালামিসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা নিহত হয়েছেন এবং ইরানের মতে ৬০০ জনেরও বেশি বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। অপরদিকে, ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরায়েলি শহরগুলোতে কমপক্ষে ২৮ জন নিহত হয়েছেন।
ইরানের Chamran-1 স্যাটেলাইট: মহাকাশ গবেষণায় নতুন মাইলফলক
এই সংকটময় মুহূর্তে ভারতের বিভিন্ন মহল থেকে ইরানের প্রতি সমর্থনের কণ্ঠস্বর উঠেছিল। বিশেষ করে কংগ্রেস দলের নেতারা, যাদের মধ্যে প্রাক্তন সভাপতি সোনিয়া গান্ধীও রয়েছেন, তেহরানের প্রতি পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করেছিলেন1। একই সাথে, সাধারণ মানুষও সামাজিক মাধ্যমে ইরানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন এবং ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সমালোচনা করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সাথে টেলিফোনে কথা বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন এবং পরিস্থিতি শান্ত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন1। ভারত সরকার যদিও সংযত অবস্থান বজায় রেখেছিল এবং উভয় পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছিল, কিন্তু বিভিন্ন মহল থেকে ইরানের প্রতি সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল।
যুদ্ধের সময় ভারত ‘অপারেশন সিন্ধু’ নামে একটি বিশেষ উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে ইরানে আটকে পড়া ৩০০০ এরও বেশি ভারতীয় নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে এনেছে। এই উদ্ধার কার্যক্রমে ইরান পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করেছে এবং বিশেষ বিমান ও বাসের ব্যবস্থা করেছে6। এমনকি ইরান তার বিমানপথ ভারতীয় উদ্ধার বিমানের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। ট্রাম্প গত মঙ্গলবার ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন, যা বুধবার থেকে কার্যকর হয়েছে। ভারত এই যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়েছে এবং এর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের ভূমিকার প্রশংসা করেছে।
ইরানের কুদস ফোর্সের নতুন কমান্ডার ইসমাইল কানি: একজন ছায়াযোদ্ধার
ইরানি দূতাবাস তাদের বিবৃতিতে জোর দিয়েছে যে ভারতের সমর্থন “জাতিসমূহের জাগ্রত বিবেক এবং ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক আইনের নীতিমালার প্রতি তাদের অঙ্গীকারের প্রতিফলন”। দূতাবাস আরও বলেছে যে ইরানি জনগণ “জায়নবাদী দখলদার শাসনের নৃশংস সামরিক আক্রমণের” সময় ভারতের এই সংহতি ও নৈতিক সমর্থনের বার্তা তাদের জন্য “গভীর উৎসাহের উৎস” ছিল।
দূতাবাসের বিবৃতির শেষে “জয় ইরান-জয় হিন্দ” স্লোগান দিয়ে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক ও সভ্যতাগত বন্ধনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ইরান উল্লেখ করেছে যে এই সংহতি দুই জাতির মধ্যে “দীর্ঘস্থায়ী সাংস্কৃতিক, সভ্যতাগত এবং মানবিক সম্পর্কের” ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এবং এটি “শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচারের” লক্ষ্যকে আরও শক্তিশালী করবে।
এই ঘটনা ভারত-ইরান সম্পর্কের একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং দেখিয়েছে যে কূটনৈতিক জটিলতা সত্ত্বেও দুই দেশের মানুষের মধ্যে গভীর বন্ধন রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সংকটের সময়ও অটুট থাকে।