Iran Israel conflict 2025:২০২৫ সালের ১৯ জুন, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ইরান প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের ওপর ক্লাস্টার বম্ব (Cluster Bomb) ছুঁড়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, এই হামলায় ইরান একটি মিসাইল ব্যবহার করে, যার ওয়ারহেড ছিল ক্লাস্টার মিউনিশন—অর্থাৎ, এটি আকাশে বিস্ফোরিত হয়ে বহু ছোট ছোট বোমা বা সাবমিউনিশন ছড়িয়ে দেয়। এই ঘটনাটি শুধু চলমান যুদ্ধের গতিপথই বদলায়নি, বরং আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
ক্লাস্টার বম্ব (Cluster Bomb) কী? সহজ ভাষায় জানুন
ক্লাস্টার বম্ব হলো এক ধরনের বিস্ফোরক অস্ত্র, যা মূলত একটি বড় বোমার ভেতরে বহু ছোট ছোট বোমা (বোমলেট বা সাবমিউনিশন) বহন করে। মিসাইল বা বিমান থেকে ফেলার পর নির্দিষ্ট উচ্চতায় এটি বিস্ফোরিত হয় এবং বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছোট ছোট বোমাগুলো ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি সাবমিউনিশন নিজ নিজ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য ডিজাইন করা। ফলে, একসঙ্গে বড় এলাকা ধ্বংস করা যায়—এটাই ক্লাস্টার বম্বের মূল ‘বিশেষত্ব’।
-
একটি ক্লাস্টার বম্ব সাধারণত কয়েক ডজন থেকে কয়েক শত সাবমিউনিশন ছড়াতে পারে।
-
এসব সাবমিউনিশনের ওজন সাধারণত ২০ কেজির কম হয়।
-
অনেক সাবমিউনিশন সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত না-ও হতে পারে, ফলে যুদ্ধের বহু বছর পরও এগুলো মারাত্মক বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ইসরায়েলে ইরানের ক্লাস্টার বম্ব হামলার বিস্তারিত
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ইরান থেকে ছোড়া মিসাইলটি প্রায় ৭ কিলোমিটার উচ্চতায় বিস্ফোরিত হয় এবং ৮ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে প্রায় ২০টি সাবমিউনিশন ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে একটি সাবমিউনিশন ইসরায়েলের আজোর শহরে একটি বাড়িতে আঘাত হানে, যদিও কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে, বিস্ফোরিত না হওয়া সাবমিউনিশনগুলো এলাকাবাসীর জন্য দীর্ঘদিন ধরে বিপজ্জনক রয়ে যায়।
এই হামলার মূল লক্ষ্য ছিল জনবসতিপূর্ণ এলাকা, যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো এবং বেশি ক্ষয়ক্ষতি ঘটানো যায়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ক্লাস্টার বম্ব ব্যবহার নিষিদ্ধ—কিন্তু ইরান ও ইসরায়েল উভয়েই এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি।
ক্লাস্টার বম্ব: কেন এত বিতর্কিত ও ভয়ংকর?
১. ব্যাপক ধ্বংস ও অন্ধকার মৃত্যু
ক্লাস্টার বম্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—এটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর বাইরে গিয়ে সাধারণ মানুষের ওপরও আঘাত হানে। কারণ, সাবমিউনিশনগুলো এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক সময় সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হয় না। ফলে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার বহু বছর পরও এগুলো জমিতে পড়ে থেকে যায়, যা শিশু ও সাধারণ মানুষের জন্য প্রাণঘাতী ফাঁদে পরিণত হয়।
২. দীর্ঘমেয়াদি মানবিক বিপর্যয়
-
ক্লাস্টার বম্বের অব্যবহৃত সাবমিউনিশন (UXO) জমিতে থেকে যায় এবং কৃষিকাজ, মানবিক সহায়তা, এমনকি সাধারণ চলাচলও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
-
২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে ক্লাস্টার বম্বের কারণে ১,১৭২ জন হতাহত হয়েছেন, যার ৯৫% ছিল সাধারণ মানুষ এবং ৭১% ছিল শিশু।
৩. আন্তর্জাতিক আইন ও নিষেধাজ্ঞা
২০০৮ সালে ১০৭টি দেশ ‘কনভেনশন অন ক্লাস্টার মিউনিশনস’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যেখানে ক্লাস্টার বম্বের ব্যবহার, সংরক্ষণ ও রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে ১২৪টি দেশ এই চুক্তির আওতায় থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ইসরায়েল, ইরান, ভারত—বিশ্বের বড় শক্তিগুলো এখনও এই চুক্তিতে নেই। ফলে, বাস্তবে নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা অনেকটাই সীমিত।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে ক্লাস্টার বম্ব ব্যবহারের তাৎপর্য
ইরান ও ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সংঘাতে ক্লাস্টার বম্ব ব্যবহারের ঘটনা যুদ্ধের নৈতিকতা ও মানবিকতার প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বলছে, ইরান ইচ্ছাকৃতভাবে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় এই অস্ত্র ব্যবহার করেছে, যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো যায়। আন্তর্জাতিক মহল থেকে এই হামলার তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে।
ক্লাস্টার বম্ব (Cluster Bomb): বৈশ্বিক পরিসংখ্যান ও মানবিক বিপর্যয়
-
১৯৬০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ক্লাস্টার বম্বের কারণে আনুমানিক ৫৬,০০০ থেকে ১,০০,০০০ মানুষ হতাহত হয়েছেন।
-
২০২২ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে এই সংখ্যা নতুন রেকর্ড ছুঁয়েছে।
-
ক্লাস্টার বম্বের অব্যবহৃত সাবমিউনিশন জমিতে পড়ে থেকে যায়, যা ভবিষ্যতে শিশু ও কৃষকের জন্য প্রাণঘাতী ফাঁদ তৈরি করে।
-
২০০৬ সালে লেবাননে ইসরায়েলি হামলার পর, জাতিসংঘ জানায়, প্রায় ১০ লাখ অব্যবহৃত সাবমিউনিশন জমিতে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ক্লাস্টার বম্বের (Cluster Bomb) ভবিষ্যৎ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ ক্লাস্টার বম্ব নিষিদ্ধ করলেও, যুদ্ধক্ষেত্রে এখনও এর ব্যবহার বন্ধ হয়নি। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার দাবি জানিয়ে আসছে—এই অস্ত্রের ব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। কারণ, যুদ্ধ শেষ হলেও এর ক্ষতচিহ্ন থেকে যায় বহু বছর ধরে।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে প্রথমবার ক্লাস্টার বম্ব ব্যবহারের ঘটনা শুধু যুদ্ধের কৌশলগত দিক নয়, বরং মানবিক বিপর্যয়ের নতুন অধ্যায়ও সূচিত করেছে। এই অস্ত্রের মূল ‘বিশেষত্ব’ হলো—একসঙ্গে বড় এলাকা ধ্বংস করা, কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সাধারণ মানুষের জন্য চরম বিপদ ডেকে আনে। সুতরাং, ক্লাস্টার বম্ব (Cluster Bomb) নিয়ে বৈশ্বিক উদ্বেগ আরও বেড়েছে এবং যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের দাবি—এই নিষিদ্ধ অস্ত্রের ব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ হোক।