Iranian underground missile base: ইরানের সামরিক শক্তির অন্যতম রহস্যময় ও আলোচিত অধ্যায় হলো তাদের ভূগর্ভস্থ ‘মিসাইল সিটি’ বা ক্ষেপণাস্ত্র নগরী। সাম্প্রতিক ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এবং যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের মধ্যেও এই ঘাঁটিগুলো ইরানের প্রতিরোধের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। পাহাড়ের গভীরে নির্মিত এই সুড়ঙ্গঘাঁটিগুলো কেবল ক্ষেপণাস্ত্র মজুত বা উৎক্ষেপণের স্থানই নয়, বরং ইরানের সামগ্রিক সামরিক কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
পাহাড়ের নিচে গড়ে ওঠা এই ‘মিসাইল সিটি’গুলোতে কী হয়, কেন এগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ এবং কীভাবে ইরান এগুলো ব্যবহার করছে—এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে উঠে আসে এক বিস্ময়কর বাস্তবতা। ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) গত কয়েক বছর ধরে দেশব্যাপী শতাধিক গোপন সুড়ঙ্গঘাঁটি নির্মাণ করেছে, যেগুলোর অবস্থান সাধারণত দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল ও মরুভূমির নিচে। এই সুড়ঙ্গগুলো একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত এবং মাটির ৫০০ মিটার গভীরে, বহুস্তর সুরক্ষা দেওয়া কংক্রিটের আবরণে ঢাকা।
এই ঘাঁটিগুলোতে গোপনে মজুত রাখা হয় বিভিন্ন ধরনের ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ছোট আকারের যুদ্ধজাহাজও। শুধু মজুত নয়, কিছু ‘মিসাইল সিটি’ সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন ও পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে এসব ঘাঁটিতে তৈরি হয়েছে ক্লাইমেট কন্ট্রোল সিস্টেম, ইলেকট্রনিক টেস্টিং ল্যাব, এবং মোবাইল লঞ্চার রাখার ব্যবস্থা, যাতে যেকোনো মুহূর্তে দ্রুত পাল্টা হামলা চালানো যায়।
সাম্প্রতিক সংঘাতে দেখা গেছে, ইরান এই সুড়ঙ্গঘাঁটি থেকে ইসরায়েলের দিকে ধারাবাহিকভাবে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে। হামলার পরপরই মিসাইলবাহী যান দ্রুত টানেলের ভেতরে ঢুকে পড়ে, ফলে পাল্টা আঘাতের আশঙ্কা কমে যায়। খোরামশাহ, ফার্স ও কেরমানশাহ প্রদেশের সুড়ঙ্গঘাঁটি থেকে এসব হামলা চালানো হয়েছে বলে জানা গেছে4। বিশ্লেষকদের মতে, এই ভূগর্ভস্থ অবকাঠামো ইরানের সামরিক কৌশলে মৌলিক পরিবর্তন এনেছে এবং শত্রু পক্ষের জন্য চরম চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
ইরানের ‘মিসাইল সিটি’গুলো এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যাতে স্যাটেলাইট বা গোয়েন্দা নজরদারির আওতা এড়িয়ে চলা যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল বহুবার এসব ঘাঁটির অবস্থান শনাক্ত করার চেষ্টা করলেও এখনো পর্যন্ত বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। কারণ, সুড়ঙ্গগুলো এতটাই গভীর ও সুরক্ষিত যে প্রচলিত বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে এগুলো ধ্বংস করা অত্যন্ত কঠিন।
আইআরজিসি-র শীর্ষ কর্মকর্তারা একাধিকবার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসব ঘাঁটির ভিডিও প্রকাশ করেছেন। এসব ভিডিওতে দেখা যায়, সুড়ঙ্গের ভেতরে সারি সারি ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, মোবাইল লঞ্চার এবং আধুনিক অস্ত্র-প্রযুক্তি মজুত রাখা হয়েছে। আইআরজিসি-র এয়ারস্পেস ফোর্সের কমান্ডারদের মতে, এসব ঘাঁটি থেকে যেকোনো সময় শত্রুপক্ষের ওপর পাল্টা হামলা চালানো সম্ভব। কিছু ঘাঁটিতে আবার ড্রোনের বিশাল সংগ্রহশালা রয়েছে, যা প্রয়োজনে দ্রুত ব্যবহার করা যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ভূগর্ভস্থ ‘মিসাইল সিটি’ ইরানকে এক অনন্য কৌশলগত সুবিধা দিয়েছে। একদিকে যেমন দেশটির সামরিক শক্তি অনেক বেশি সুরক্ষিত, অন্যদিকে শত্রুপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্যও এটি কার্যকর। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল জোট যদি বড় ধরনের হামলা চালায়, তাহলে এই ঘাঁটি থেকেই দ্রুত ও ব্যাপক পাল্টা হামলা সম্ভব—এমন হুমকি ইরান বারবার দিয়েছে। আইআরজিসি-র মতে, ‘মিসাইল সিটি’ হচ্ছে ইরানের প্রতিরোধের দুর্গ, যা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে দেখা গেছে, ইরানের এই ভূগর্ভস্থ ঘাঁটিগুলোই তাদের অব্যাহত প্রতিরোধের মূল উৎস। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পরও ইরান নিয়মিত পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, যার বড় অংশই পরিচালিত হচ্ছে এই ‘মিসাইল সিটি’ থেকে। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য এসব সুড়ঙ্গঘাঁটি এখন এক অজানা আতঙ্ক, কারণ এগুলোর অবস্থান চিহ্নিত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সবশেষে বলা যায়, ইরানের ‘মিসাইল সিটি’ শুধু একটি সামরিক ঘাঁটি নয়, বরং এটি দেশটির প্রতিরোধ ও আত্মরক্ষার প্রতীক। পাহাড়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা এই সুড়ঙ্গঘাঁটিগুলো ইরানকে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস, শত্রুপক্ষের ওপর চাপ এবং সর্বোপরি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার অদম্য শক্তি। বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে এই ‘মিসাইল সিটি’ ইরানের জন্য এক অদৃশ্য ঢাল হয়ে উঠেছে, যা তাদের প্রতিপক্ষের জন্য সর্বদা এক অজানা ও অপ্রতিরোধ্য হুমকি হিসেবে থেকে যাবে।