Is Amavasya auspicious or inauspicious?: প্রতি মাসে যখন চাঁদ সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যায়, তখন সেই দিনটিকে বলা হয় অমাবস্যা। কিন্তু অমাবস্যা শুভ নাকি অশুভ – এই প্রশ্নটি হাজার বছর ধরে মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। হিন্দু সনাতন ধর্মে অমাবস্যার অপরিসীম ধর্মীয় তাৎপর্য রয়েছে, তবে এই তিথি নিয়ে বিভিন্ন মতামত ও বিশ্বাস প্রচলিত আছে। কেউ এটিকে অত্যন্ত পবিত্র ও শুভ মনে করেন, আবার অনেকেই এই দিনটিকে অশুভ বলে বিবেচনা করেন। আসুন জেনে নিই অমাবস্যার প্রকৃত তাৎপর্য এবং এটি আসলেই শুভ নাকি অশুভ।
অমাবস্যা কী এবং এর ধর্মীয় পরিচয়
অমাবস্যা হল সংস্কৃত ভাষায় অমাবস্যার চন্দ্র পর্ব, যখন চাঁদ সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে এমনভাবে অবস্থান করে যে তা একেবারেই দেখা যায় না। হিন্দু পঞ্জিকায় এটি একটি বিশেষ তিথি হিসেবে পরিগণিত। এই দিনে চাঁদ সূর্য ও চাঁদের মধ্যে কৌণিক দূরত্বের ১২ ডিগ্রির মধ্যে থাকে।
প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি এবং বিশ্বাসে, ধর্ম নির্বিশেষে, অমাবস্যাকে মহান শক্তির সময় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ঋগ্বেদেও অমাবস্যার উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে এই দিনটিকে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্য পবিত্র সময় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
অমাবস্যা শুভ নাকি অশুভ: ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে শুভ দিক
পূর্বপুরুষ পূজার পবিত্র দিন
অমাবস্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এটি পূর্বপুরুষদের পূজার জন্য অত্যন্ত শুভ। প্রতি মাসে অমাবস্যার দিনটি পিতৃপুরুষদের পূজার জন্য শুভ বলে মনে করা হয় এবং পূজা করা হয়। ব্রাহ্মণগণ যাদের পিতা মারা গেছেন তাদের পূর্বপুরুষদের শ্রাদ্ধ করেন।
এই দিনে কালো তিল এবং জল নিবেদন করা হয় বিদেহী আত্মার জন্য। এই উৎসর্গ পিতা, দাদা, প্রপিতামহ, মা, দাদী এবং প্রপিতামহকে দেওয়া হয়। বিশ্বাস করা হয় যে এই উৎসর্গগুলি মানসিক বা শারীরিক চ্যালেঞ্জ ছাড়াই ভাল সন্তানের জন্ম দেয়।
আধ্যাত্মিক সাধনার উৎকৃষ্ট সময়
অমাবস্যা শুভ নাকি অশুভ এই প্রশ্নের উত্তরে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে এটি অত্যন্ত শুভ। যখন আকাশে চাঁদ থাকে না, তখন বাইরের জগতের দিকে তাকানোর চেয়ে নিজের অন্তর্দৃষ্টির দিকে মনোনিবেশ করার উৎকৃষ্ট সময়।
আধ্যাত্মিক সাধকরা, বিশেষ করে যারা তন্ত্র সাধনা করেন, তারা বিশ্বাস করেন এটি দীক্ষার জন্য নিখুঁত দিন। অমাবস্যা মোক্ষ বা নির্বাণের সাথে গভীরভাবে জড়িত। এই দিনে পার্থিব বিক্ষেপ থেকে দূরে থেকে অন্তর্দৃষ্টি খোঁজার সময়।
দান ও পুণ্যকর্মের বিশেষ দিন
অমাবস্যায় দান ধ্যান করা অত্যন্ত পুণ্যের কাজ বলে বিবেচিত। এই দিনে তিল, তেল, কম্বল, কাপড় আর ধনের দান করলে প্রচুর পুণ্য হয়। যাদের রাশিতে শনির প্রভাব বেশি তারা এই দিনে দানধ্যান করলে লাভবান হন।
কেন অনেকে অমাবস্যাকে অশুভ মনে করেন
নেতিবাচক শক্তির বিশ্বাস
অনেকের ধারণা অমাবস্যায় নেতিবাচক শক্তির প্রভাব বেশি থাকে। এই দিনে অশুভ আত্মার শক্তি শক্তিশালী হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। চাঁদহীন আকাশ ভূত-প্রেতদের ভয়ঙ্কর করে তোলে এবং তাদের শ্মশানে ঘুরে বেড়াতে উৎসাহিত করে বলে অনেকে মনে করেন।
কাজকর্মের উপর বিধিনিষেধ
অমাবস্যায় নতুন কোনো কাজ, প্রকল্প বা কার্যকলাপ শুরু করা উচিত নয় বলে বিশ্বাস করা হয়। প্রায় সব জ্যোতিষী অমাবস্যায় কোনো পূজা বা অনুষ্ঠান করার বিরুদ্ধে পরামর্শ দেন। এই দিনে চুল কাটা, গাছ কাটা নিষিদ্ধ বলে মনে করা হয়।
ঐতিহ্যবাহী কর্মীরা যেমন রাজমিস্ত্রিরা ভারতে অমাবস্যায় কাজ করেন না। এমনকি কয়েক দশক আগে পর্যন্ত কেউ অমাবস্যার দিনে ভ্রমণ শুরু করতেন না।
মৌনী অমাবস্যার বিশেষ তাৎপর্য
মাঘ মাসের অমাবস্যা তিথি মৌনী অমাবস্যা নামে পরিচিত এবং এটি অত্যন্ত পবিত্র বলে বিবেচিত। ২০২৫ সালে এটি ২৯ জানুয়ারি পালিত হবে। এদিন পৃথিবীতে নেমে এসে ঈশ্বর তাঁর রূপ পরিবর্তন করেন বলে প্রচলিত বিশ্বাস।
মৌনী অমাবস্যার আচার-অনুষ্ঠান
এদিন নিঃশব্দে থাকার বিধান রয়েছে হিন্দুধর্মে। উপবাস রেখে এদিন নিঃশব্দে স্নান সারতে হয় ও পুজো অর্চণা করতে হয়। মৌনব্রত পালন করলে মানসিক শান্তি পাওয়া যায় এবং রোগমুক্তি ঘটে বলে অনেকে বিশ্বাস করেন।
গঙ্গা নদীর জল মৌনী অমাবস্যায় অমৃতে পরিণত হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। এই দিনে পবিত্র নদীতে স্নান করা অত্যন্ত শুভ। ২০২৫ সালে প্রায় ৬ কোটি মানুষ মৌনী অমাবস্যায় শাহী স্নানে অংশগ্রহণ করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অমাবস্যায় করণীয় ও বর্জনীয় কাজ
যা করা উচিত
পূর্বপুরুষদের তর্পণ: এই দিনে পিতৃপুরুষদের তর্পণ করা শুভ বলে হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে। কালো তিল ও জল দিয়ে পূর্বপুরুষদের স্মরণ করা উচিত।
উপবাস ও ধ্যান: অমাবস্যায় উপবাস করা এবং আধ্যাত্মিক সাধনায় মনোনিবেশ করা অত্যন্ত ফলপ্রসূ।
দান-ধ্যান: এই দিনে দরিদ্রদের দান করা, বিশেষ করে তিল, তেল, কাপড় ও খাবার দান করা পুণ্যের কাজ।
যা এড়িয়ে চলা উচিত
ভ্রমণ: অমাবস্যায় যথাসম্ভব ভ্রমণ করা উচিত নয়। বিশেষ করে অমাবস্যার রাতে ভ্রমণ স্থগিত রাখাই উত্তম।
মাংস খাওয়া: এই দিনে মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। যথাসম্ভব শাকসবজি খাওয়া উচিত।
কলহ-বিবাদ: কোনো কলহ বিবাদে জড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। অন্যথায় পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।
অমাবস্যা শুভ নাকি অশুভ: বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, চাঁদ মানুষের মানসিক অবস্থার উপর প্রভাব ফেলে। জ্যোতিষশাস্ত্র এবং বিজ্ঞান উভয়ই বলে যে চাঁদ যখন পুরোপুরি দেখা যায় না, তখন মানুষের মনের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর জোয়ার-ভাটার উপর প্রভাব ফেলে। যেহেতু মানুষের শরীরে ৭০% জল রয়েছে, তাই চাঁদের প্রভাব মানুষের উপরও পড়ে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। অমাবস্যায় চাঁদ অদৃশ্য থাকায় এর প্রভাব ভিন্ন হতে পারে।
আঞ্চলিক বৈচিত্র্য এবং বিভিন্ন ধর্মে অমাবস্যা
হিন্দুধর্মে বৈচিত্র্য
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অমাবস্যার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। মাঘের মৌনী অমাবস্যা এবং আশ্বিনের মহালয়া অমাবস্যা হিন্দুধর্মে শুভ বলে বিবেচিত। তামিলনাড়ুতে আদি অমাবস্যা এবং কেরালায় কর্কিদকম মাসের অমাবস্যা বিশেষ গুরুত্ব পায়।
অন্যান্য ধর্মে অমাবস্যা
জৈনধর্মে: অমাবস্যা উপবাস, প্রার্থনা এবং আত্মসংযমের দিন হিসেবে পালিত হয়।
বৌদ্ধধর্মে: এই দিনটি প্রতিফলন এবং মননশীলতার প্রতীক। বৌদ্ধরা এই সময়ে ধর্মের গভীর বোঝাপড়ার জন্য ধ্যান ও প্রার্থনায় মনোনিবেশ করেন।
অমাবস্যার পূজা ও এর উপকারিতা
অমাবস্যার পূজায় সাধারণত দেবী কালী এবং ভগবান শিবের পূজা করা হয় নেতিবাচক শক্তি এবং অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করতে। এই পূজা কাল সর্প দোষের নেতিবাচক প্রভাব নির্মূল বা কমাতে অত্যন্ত সহায়ক।
অমাবস্যার পূজা একজনকে আনন্দদায়ক এবং শান্ত করে এবং সমস্ত ক্ষতিকারক ও অশুভ শক্তি থেকে রক্ষা করে। পূর্বপুরুষদের সন্তুষ্ট করে এবং তারা তাদের বংশধরদের সমৃদ্ধি, সুখ এবং প্রশান্তি প্রদান করেন।
আধুনিক যুগে অমাবস্যার প্রাসঙ্গিকতা
আজকের আধুনিক যুগেও অমাবস্যার গুরুত্ব কমেনি। মানসিক স্বাস্থ্য ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য এই দিনটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ব্যস্ত জীবনযাত্রায় অমাবস্যা আমাদের নিজেদের অন্তর্দৃষ্টির দিকে তাকানোর সুযোগ দেয়।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে নিয়মিত ধ্যান ও আত্মচিন্তা মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। অমাবস্যার দিনে এই ধরনের অনুশীলন করা অত্যন্ত ফলপ্রসূ।
তবে অমাবস্যা শুভ নাকি অশুভ এই প্রশ্নের উত্তর একেবারে কালো-সাদা নয়। এটি নির্ভর করে ব্যক্তিগত বিশ্বাস, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতের উপর। যারা আধ্যাত্মিক সাধনায় আগ্রহী, তাদের কাছে অমাবস্যা অত্যন্ত পবিত্র ও শুভ। অন্যদিকে, যারা এর নেতিবাচক দিকে বিশ্বাস করেন, তারা এটিকে এড়িয়ে চলেন।
সর্বোপরি, অমাবস্যা প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এর শুভ-অশুভত্ব নির্ভর করে আমাদের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর। যদি আমরা এই দিনটিকে আত্মচিন্তা, পূর্বপুরুষদের স্মরণ এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য ব্যবহার করি, তাহলে এটি নিশ্চয়ই শুভ। আর যদি কুসংস্কার ও ভীতির বশবর্তী হয়ে থাকি, তাহলে তা অশুভই মনে হবে।