হরিয়ানার ইউটিউবার জ্যোতি মালহোত্রা আসলে গুপ্তচর? চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস!

Jyoti Malhotra spy controversy: পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যোগাযোগ, মাস দুয়েক আগে পাকিস্তান ভ্রমণ, এনক্রিপ্টেড অ্যাপে গোপন বার্তা আদান-প্রদান - এসবই এখন হরিয়ানার এক ইউটিউবার জ্যোতি মালহোত্রার বিরুদ্ধে উঠে আসা…

Avatar

 

Jyoti Malhotra spy controversy: পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যোগাযোগ, মাস দুয়েক আগে পাকিস্তান ভ্রমণ, এনক্রিপ্টেড অ্যাপে গোপন বার্তা আদান-প্রদান – এসবই এখন হরিয়ানার এক ইউটিউবার জ্যোতি মালহোত্রার বিরুদ্ধে উঠে আসা অভিযোগ। ভ্রমণ ভিডিয়ো বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলোয়ারদের মুগ্ধ করা এই তরুণী এবার গ্রেফতার হয়েছেন পাকিস্তানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে। বিশেষ করে পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার ঠিক আগে তার পাকিস্তান সফর এবং পাক গুপ্তচরদের সাথে যোগাযোগের প্রমাণ পেয়ে তাকে গ্রেফতার করেছে হরিয়ানা পুলিশ। আসুন জেনে নেওয়া যাক কে এই জ্যোতি মালহোত্রা এবং কীভাবে একজন জনপ্রিয় ইউটিউবার পরিণত হলেন দেশের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তিতে অভিযুক্ত আসামিতে।

কে এই জ্যোতি মালহোত্রা?

জ্যোতি মালহোত্রা হরিয়ানার হিসার জেলার বাসিন্দা, যিনি কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন। তিনি একজন জনপ্রিয় ইউটিউবার ও সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার, যার “ট্রাভেল উইথ জো” নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। এই চ্যানেলে তার অনুগামীর সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ৩২ হাজার থেকে ৩ লক্ষ ৭৭ হাজারের বেশি (বিভিন্ন সূত্রে সংখ্যা আলাদা)। ইনস্টাগ্রামে তার ফলোয়ার সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ৩১ হাজার। ভারতের বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও তিনি ইন্দোনেশিয়া, চীন এবং পাকিস্তান সহ বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং সেসব ভ্রমণের ভিডিয়ো তার চ্যানেলে প্রকাশ করেছেন।

জ্যোতির ভ্রমণ ভিডিয়োগুলি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, বিশেষ করে তার পাকিস্তান ভ্রমণের ভিডিয়োগুলি যেখানে তিনি অটারী-ওয়াঘা সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তান যাওয়া, লাহৌরের আনারকলি বাজার ঘুরে দেখা, পাকিস্তানের খাবার এবং সংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্ন ভিডিয়ো বানিয়েছিলেন।

পাকিস্তান সফর এবং জঙ্গি হামলার সময়কাল

তদন্তকারীদের সূত্রে জানা যায় যে জ্যোতি প্রথমবার ২০২৩ সালে পাকিস্তান যান। পরবর্তীতে আরও কয়েকবার তিনি পাকিস্তান ভ্রমণ করেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, তিনি মাস দুয়েক আগে, অর্থাৎ পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলায় ২৬ জনের মৃত্যুর ঘটনার আগে পাকিস্তান গিয়েছিলেন। এই সময়সূচী তদন্তকারীদের বিশেষভাবে নজরে এসেছে।

উল্লেখ্য যে, ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার পহেলগাঁওয়ের বৈসারান উপত্যকায় জঙ্গি হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হয়েছিলেন, যাদের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের পর্যটক ও স্থানীয় বাসিন্দারা ছিলেন। এমনকি, নিহতদের মধ্যে দুইজন বিদেশি পর্যটকও ছিলেন।

পাকিস্তানি গুপ্তচরদের সাথে যোগাযোগ

তদন্তকারীদের অভিযোগ, জ্যোতি মালহোত্রার পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সাথে গভীর যোগাযোগ রয়েছে। ২০২৩ সালে তার প্রথম পাকিস্তান সফরের সময়ই নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান হাই কমিশনের আধিকারিক এহসান-উর-রহিম ওরফে দানিশের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। গুপ্তচরবৃত্তি সংক্রান্ত অভিযোগে চলতি সপ্তাহেই দানিশকে ভারতে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করা হয়েছে।

অভিযোগ অনুসারে, দানিশের মাধ্যমেই পাক গুপ্তচর সংস্থার একাধিক আধিকারিকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল জ্যোতির। দেশে ফিরে আসার পর তিনি হোয়াটস্অ্যাপ, টেলিগ্রাম এবং স্ন্যাপচ্যাট ব্যবহার করে পাকিস্তানি গুপ্তচরদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। জ্যোতি পাকিস্তানি চরদের পরিচয় গোপন রাখতে মোবাইলে অন্য নামে সেই নম্বরগুলি সংরক্ষণ করতেন।

গোপন কোডনাম এবং কার্যপ্রণালী

তদন্তে আরও উঠে এসেছে যে জ্যোতি তার ফোনে পাকিস্তানি গুপ্তচরদের নম্বর ভিন্ন নামে সেভ করে রাখতেন। তার মধ্যে ‘জাট রানধাওয়া’ নামে একটি নম্বর সেভ করা ছিল। তদন্তকারীদের সন্দেহ, ওই নম্বরটি আসলে পাকিস্তানি চর শাকির ওরফে রানা শাহবাজের। এর পাশাপাশি একটি পাকিস্তানি চরের সঙ্গে তাঁর ‘ঘনিষ্ঠতা’ও তৈরি হয়েছিল বলে তদন্তকারীরা অনুমান করছেন।

শুধু তাই নয়, তদন্তে আরও প্রকাশ পেয়েছে যে জ্যোতি সেই পাকিস্তানি গুপ্তচরদের সাথে বালি এবং ইন্দোনেশিয়া ঘুরতেও গিয়েছিলেন।

পাকিস্তান হাই কমিশনে জ্যোতির উপস্থিতি

গবেষণা এবং তদন্তের মাধ্যমে তার একটি ভিডিয়ো খুঁজে পাওয়া গেছে যেটি গত বছর ৩০ মার্চ পোস্ট করা হয়েছিল। সেই ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তান হাই কমিশনে গিয়েছিলেন জ্যোতি। সেখানে তিনি একজন ব্যক্তির সাথে কুশল বিনিময় করেছেন যাকে তদন্তকারীরা দানিশ বলে সনাক্ত করেছেন।

ওই ভিডিয়োতে জ্যোতিকে বলতে শোনা গিয়েছে, “আমি মুগ্ধ। কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।” দানিশ তার স্ত্রীর সাথেও জ্যোতির পরিচয় করিয়ে দেন এবং জ্যোতি তাদের হরিয়ানার হিসারের বাড়িতে যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণও করেন। পাকিস্তান হাই কমিশনের আরও কয়েকজন আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলতেও দেখা গিয়েছিল জ্যোতিকে, যাদের কাছে ভিসার ব্যবস্থা করে দেওয়ার আর্জি জানিয়েছিলেন তিনি।

কাশ্মীর ভ্রমণ এবং পহেলগাঁও সম্পর্কে ভিডিয়ো

জ্যোতি শুধু পাকিস্তানই নয়, গত বছর কাশ্মীরেও গিয়েছিলেন। সেখানে ডাল হ্রদে শিকারায় করে ঘুরার ভিডিয়োও তার চ্যানেলে রয়েছে। ট্রেনে করে শ্রীনগর থেকে বনিহাল যাওয়ার একটি ভিডিয়োও পোস্ট করেছিলেন তিনি।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, গত এপ্রিল মাসে পহেলগাঁও কাণ্ডের পর জ্যোতি একটি ভিডিয়ো পোস্ট করেছিলেন। তার বর্ণনায় লেখা ছিল, “কাশ্মীর পহেলগাঁও নিয়ে আমার মতামত: আমাদের কি আবার কাশ্মীর যাওয়া উচিত?” এই ভিডিয়োটিও তদন্তকারীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।

পাকিস্তানের প্রচার মাধ্যম হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়া

তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার হওয়ার কারণে পাকিস্তানের এজেন্টরা জ্যোতিকে দিয়ে প্রচারমূলক ভিডিয়ো ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন। জ্যোতির পাকিস্তান ভ্রমণের ভিডিয়োতে সে দেশের ইতিবাচক দিকগুলি বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। যেমন, ওয়াঘা-আটারি বর্ডার সীমান্ত পেরোনো, লাহোরের আনারকলি বাজার ঘোরা, পাক পঞ্জাবের কটাস রাজ মন্দির পরিদর্শন, ভারত-পাকিস্তানের সংস্কৃতির তুলনামূলক আলোচনা ইত্যাদি।

ইনস্টাগ্রামের একটি ছবিতে তিনি ঊর্দুতে ‘ইশক লাহোর’ লিখেও পোস্ট করেছিলেন, যা তার পাকিস্তানের প্রতি আকর্ষণ প্রকাশ করে।

অন্যান্য অভিযুক্তরা এবং ব্যাপক চক্র

শুধু জ্যোতি নন, পাকিস্তানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে আরও পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে হরিয়ানা পুলিশ। তদন্তকারীদের অনুমান, ভারতের গোপন তথ্য পাকিস্তানে পাচার করার একটি বড় চক্র সক্রিয় রয়েছে এ দেশে। এই চক্র মূলত পঞ্জাব এবং হরিয়ানায় বেশি সক্রিয়। জ্যোতি সেই চক্রেরই একজন সক্রিয় সদস্য বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।

সম্প্রতি হরিয়ানার এক ছাত্রের বিরুদ্ধেও পাকিস্তানি গুপ্তচরদের সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগ উঠেছে। ২৫ বছরের ওই ছাত্র দেবেন্দ্র সিংহ কৈঠাল জেলার বাসিন্দা। বর্তমানে পঞ্জাবের পটিয়ালার এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করছেন তিনি। অভিযোগ, গত বছরের নভেম্বরে তিনিও পাকিস্তান গিয়েছিলেন এবং সেখানে গুপ্তচরদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে তাঁর।

‘অপারেশন সিঁদুর’ সম্পর্কে গোপন তথ্য পাচার

হরিয়ানা পুলিশ এবং নিরাপত্তা সংস্থা অভিযোগ করেছে যে জ্যোতি ভারতের সামরিক অভিযান ‘অপারেশন সিঁদুর’ সহ সেনাবাহিনীর গোপন তথ্য পাকিস্তানে পাঠিয়েছেন। এই অপারেশনটি ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অভিযান ছিল।

উল্লেখ্য যে, পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডের পর ভারতীয় সেনা ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে একটি অভিযান চালিয়েছিল। এনআইএ তদন্তে জানা গেছে যে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির বাসিন্দা শেখ সাজ্জাদ গুলই পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডের মূল মাথা, যিনি টিআরএফ (‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’)-এর একজন শীর্ষ নেতা।

তদন্ত এবং বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে জ্যোতি মালহোত্রা এবং তার পাঁচ সহযোগীকে জেরা করছে হরিয়ানা পুলিশ। তাদের মোবাইল ফোন এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এবং ফরেন্সিক বিশ্লেষণের জন্য পাঠানো হয়েছে।

সাধারণত এই ধরনের মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বিভিন্ন কঠোর ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। ভারতীয় দণ্ডবিধির অধীনে এই অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।

জ্যোতি মালহোত্রার গ্রেফতারি প্রমাণ করে যে কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়া এবং ভ্রমণ ভ্লগিংয়ের মতো নির্দোষ দেখতে প্ল্যাটফর্মগুলিকেও গুপ্তচরবৃত্তির কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। তার ১৩০,০০০+ অনুগামীদের কেউই হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি যে তাদের প্রিয় ভ্রমণ ভ্লগার আসলে পাকিস্তানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তিতে জড়িত থাকতে পারেন।

পহেলগাঁও কাণ্ডের ঠিক আগে পাকিস্তান ভ্রমণ এবং তার পর সেখানকার গুপ্তচরদের সঙ্গে হোয়াট্‌সঅ্যাপে যোগাযোগ রেখে চলা – এসব প্রকাশিত তথ্য জ্যোতির বিরুদ্ধে উঠে আসা অভিযোগগুলিকে আরও জোরদার করেছে। তদন্ত এখনও চলছে এবং আরও বিস্তারিত তথ্য সামনে আসতে পারে আগামী দিনগুলিতে।এই ঘটনা থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের জনপ্রিয়তা ও পৌঁছাবার ক্ষমতাকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলি কীভাবে ব্যবহার করতে পারে দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।

About Author
Avatar

আমাদের স্টাফ রিপোর্টারগণ সর্বদা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন যাতে আপনি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পেতে পারেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রতিশ্রুতি আমাদের ওয়েবসাইটকে একটি বিশ্বস্ত তথ্যের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।তারা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ে বিশ্বাসী, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন তৈরিতে সক্ষম