ইরানের কুদস ফোর্সের নতুন কমান্ডার ইসমাইল কানি: একজন ছায়াযোদ্ধার উত্থান

ইসমাইল কানি হলেন ইরানের ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কর্পস (IRGC) এর কুদস ফোর্সের বর্তমান কমান্ডার। তিনি ২০২০ সালের জানুয়ারিতে এই পদে নিযুক্ত হন, যখন তার পূর্বসূরি কাসেম সোলেইমানি মার্কিন ড্রোন হামলায়…

Avatar

 

ইসমাইল কানি হলেন ইরানের ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কর্পস (IRGC) এর কুদস ফোর্সের বর্তমান কমান্ডার। তিনি ২০২০ সালের জানুয়ারিতে এই পদে নিযুক্ত হন, যখন তার পূর্বসূরি কাসেম সোলেইমানি মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন। ৬৭ বছর বয়সী কানি দীর্ঘদিন ধরে ইরানের সামরিক কৌশলের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে কাজ করেছেন।

কানির সামরিক ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৮০ এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়2। তিনি রেভলিউশনারি গার্ডসের হয়ে যুদ্ধ করেন এবং পরবর্তীতে নাসর-৫ ও ইমাম রেজা-২১ ডিভিশনের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন4। যুদ্ধের পর তিনি মাশহাদে IRGC গ্রাউন্ড ফোর্সেসের ডেপুটি কমান্ডার নিযুক্ত হন।

১৯৯৭ সালে কানি কুদস ফোর্সের ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন, যখন সোলেইমানি এর প্রধান কমান্ডার হন6। এই সময় থেকে তিনি সোলেইমানির ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। সোলেইমানি মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে মনোযোগ দেন, অন্যদিকে কানি আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলোতে IRGC-এর কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

ইরানের Chamran-1 স্যাটেলাইট: মহাকাশ গবেষণায় নতুন মাইলফলক

কিছু রিপোর্টে বলা হয়েছে, কানি তালেবান শাসিত আফগানিস্তান (১৯৯৬-২০০১) থেকে মাদক পাচারের বিরুদ্ধে ইরানের লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি উত্তর জোটের সাথেও কাজ করেন, যারা তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল1।

কানি ২০২০ সালে কুদস ফোর্সের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন, যখন মার্কিন ড্রোন হামলায় সোলেইমানি নিহত হন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, সোলেইমানির পথ অনুসরণ করে তিনি পশ্চিম এশিয়া থেকে মার্কিন বাহিনীকে বের করে দেবেন।

কানির নেতৃত্বে কুদস ফোর্স ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। তিনি লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী ও ইরাকের শিয়া মিলিশিয়াদের সাথে ইরানের সম্পর্ক সমন্বয় করেন।

তবে কানির নেতৃত্ব তার পূর্বসূরির মতো প্রভাবশালী নয় বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। সোলেইমানির মতো তিনি ইরানের আঞ্চলিক মিত্রদের সাথে একই ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখতে পারেননি। তিনি আরবি ভাষায় দক্ষ নন, যা ইরাক ও লেবাননের মিলিশিয়াদের সাথে তার যোগাযোগকে সীমিত করেছে।

২০২৪ সালের অক্টোবরে বৈরুতে ইসরায়েলি বিমান হামলার পর থেকে কানি নিখোঁজ বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে2। এই হামলায় হিজবুল্লাহর গোয়েন্দা সদর দপ্তর লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। কানির মৃত্যু নিশ্চিত হলে তা ইরানের আঞ্চলিক প্রভাবের জন্য বড় ধাক্কা হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

কানি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেইর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখেন। তার যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা এবং বিপ্লবী সরকারের প্রতি অবিচল আনুগত্য তাকে IRGC-তে উচ্চপদে উন্নীত করতে সাহায্য করেছে।

কানি ১৯৯৯ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামিকে উচ্চারিত একটি চিঠির স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন। এই চিঠিতে IRGC কমান্ডাররা খাতামিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, তিনি যদি ছাত্র বিক্ষোভ দমনে ব্যর্থ হন তাহলে তারা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করবে।

কানি ২০১৮ সালে আফগানিস্তানে ডেপুটি রাষ্ট্রদূতের ছদ্মবেশে সফর করেন। সেখানে তিনি বামিয়ানের গভর্নরের সাথে দেখা করেন এবং শহরে একটি ইরানি হাসপাতাল নির্মাণ নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি পাকিস্তানের শিয়া সম্প্রদায়ের সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন।

Hamas Leader News: কিভাবে নিহত হলেন হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া তেহরান?

কানি কুদস ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে প্রথম দিকে কিছু ব্যর্থতার মুখোমুখি হন। ২০২০ সালের শুরুর দিকে সিরিয়ার ইদলিবে তার নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযান ব্যর্থ হয়। তুরস্কের বিমান হামলায় IRGC-এর অবস্থান লক্ষ্যবস্তু করা হয়।

তবে পরবর্তীতে কানি নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামাস হামলার পর তিনি ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে IRGC-এর মিলিশিয়া নেটওয়ার্ককে সমন্বয় ও সংগঠিত করেন। এর ফলে তিনি খামেনেইর কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কানি ইরানের শীর্ষ নেতৃত্বে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। এর ফলে কুদস ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে তিনি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কানি প্রায়শই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানান। তিনি মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ছোটখাটো আঘাত হানলে তার মিত্রদের চোখে তা দুর্বল দেখাবে।

কানি বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল শুধুমাত্র শক্তির ভাষা বোঝে”। তবে ২০২০ ও ২০২১ সালে ইরাকে কুদস ফোর্সের প্রক্সি মিলিশিয়াদের সাথে বৈঠকে তিনি তাদের ধৈর্য ধরতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলকে যুদ্ধের কোনো অজুহাত না দিতে নির্দেশ দেন।

সামগ্রিকভাবে, ইসমাইল কানি ইরানের বৈদেশিক নীতি ও আঞ্চলিক কৌশলের একজন গুরুত্বপূর্ণ কারিগর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি কুদস ফোর্সের মাধ্যমে ইরানের প্রভাব বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন, যদিও তার পূর্বসূরি সোলেইমানির মতো কৌশলগত দক্ষতা ও ব্যক্তিগত প্রভাব তার নেই। আগামী দিনগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে কানির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

About Author
Avatar

আন্তর্জাতিক খবরের সর্বশেষ আপডেট, গভীর বিশ্লেষণ এবং বিশ্বের প্রভাবশালী ঘটনাবলীর বিস্তারিত প্রতিবেদন পেতে আমাদের International Desk-এ আসুন। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ, রাজনৈতিক গতিবিধি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সাংস্কৃতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে জানতে এই পাতাটি আপনার একমাত্র গন্তব্য।