Israel Iran conflict 2025: ইসরায়েল ও ইরানের সাম্প্রতিক সংঘাত বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে ভারতের ওপর। যদিও যুদ্ধ ও উত্তেজনার আবহে ভারতের কিছু খাতে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে, একই সঙ্গে রয়েছে বড় ধরনের ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ। ভারতের ইসরায়েল ও ইরানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা, প্রতিরক্ষা চুক্তি ও কৌশলগত বিনিয়োগ এই সংঘাতের ফলে নতুন মাত্রা পেয়েছে।
ঘটনার পূর্ণ বিবরণ:
২০২৫ সালের জুন মাসে ইসরায়েল ইরানের ওপর বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালায়, যার পাল্টা জবাব দেয় ইরান। এই সংঘাত শুধু দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে পুরো পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। ভারতের জন্য এটি একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ—প্রথমত, ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা, দ্বিতীয়ত, দুই দেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক, এবং তৃতীয়ত, কৌশলগত বিনিয়োগ ও যোগাযোগ প্রকল্প।
ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গত এক দশকে বহুগুণে বেড়েছে। প্রতিরক্ষা খাতে ভারত ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ক্রেতা এবং ইসরায়েল ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বাণিজ্য ৩৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতীয় কোম্পানি আদানি গ্রুপ ইসরায়েলের হাইফা বন্দরের অংশীদার, এছাড়া কৃষি প্রযুক্তি, সেমিকন্ডাক্টর, ফার্মাসিউটিক্যাল ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও দুই দেশের মধ্যে গভীর সহযোগিতা রয়েছে।
অন্যদিকে, ইরানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও কৌশলগত। যদিও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান থেকে তেল আমদানি কমেছে, তবু চাবাহার বন্দরে ভারতের বিনিয়োগ এবং মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য ইরান ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চাবাহার বন্দরে ভারতের বিনিয়োগ প্রায় ৩৭০ মিলিয়ন ডলার, যা মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করছে।
প্রাসঙ্গিক তথ্য ও গভীরতা:
ভারতের ইসরায়েল থেকে আমদানি ও রপ্তানি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যথাক্রমে ১.৬১ ও ২.১৫ বিলিয়ন ডলার—যেখানে ইরানের সঙ্গে একই সময়ে রপ্তানি ১.২৪ বিলিয়ন ও আমদানি ৪৪১.৯ মিলিয়ন ডলার। তবে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের কারণে ভারতীয় রপ্তানি ও আমদানি উভয়ই চাপে পড়েছে। বিশেষ করে, ভারতীয় চাল, চা ও কাঁচা চিনি ইরানে রপ্তানি হয়; আবার ইরান থেকে আসে সার, শুকনো ফল, ও অন্যান্য কাঁচামাল।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জ্বালানি নিরাপত্তা। ভারতের ৮০% তেলের চাহিদা আমদানি নির্ভর এবং এর উল্লেখযোগ্য অংশই আসে পারস্য উপসাগর দিয়ে, যা ইরানের নিয়ন্ত্রণাধীন স্ট্রেইট অব হরমুজ দিয়ে যায়। এই পথ বন্ধ হলে বা যুদ্ধবিধ্বস্ত হলে ভারতের আমদানি খরচ বাড়বে, শিল্প উৎপাদন কমবে, রুপি দুর্বল হবে এবং অর্থনৈতিক চাপ বাড়বে। ইতিমধ্যে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৯% বেড়েছে, ভারতীয় তেল কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্য ৩.৫% কমেছে।
তবে, সংঘাতের মাঝেও কিছু খাতে ভারত লাভবান হচ্ছে। ইসরায়েলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি ও কৃষি খাতে যৌথ উদ্যোগে ভারতীয় কোম্পানিগুলো কোটি কোটি টাকার চুক্তি করছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় প্রতিরক্ষা শিল্পে ইসরায়েলের রাডার, ড্রোন, মিসাইল ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেমের চাহিদা বেড়েছে। এছাড়া, ইসরায়েলের প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন খাতে ভারতীয় বিনিয়োগ বাড়ছে, যেমন সেমিকন্ডাক্টর ও ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প।
বিপরীতে, সংঘাতের ফলে ভারতের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের কারণে আন্তর্জাতিক পরিবহন ব্যয় ১৫-২০% পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে, কারণ স্ট্রেইট অব হরমুজ ও রেড সি অঞ্চল দিয়ে জাহাজ চলাচল ঝুঁকিতে পড়েছে। ভারতের বেসমাতি চাল রপ্তানিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ ইরানি ক্রেতারা পেমেন্টে দেরি করছে। চাবাহার বন্দরে ভারতের বিনিয়োগও অনিশ্চয়তার মুখে, কারণ যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
ভারতের কৌশলগত অবস্থান:
ভারত বরাবরই কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রেখে চলে—ইসরায়েল ও ইরান উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখে। এই সংঘাতের মধ্যেও ভারত কোনো পক্ষ নেয়নি এবং কূটনৈতিকভাবে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। কারণ, পশ্চিম এশিয়ায় প্রায় ৯০ লাখ ভারতীয় কর্মরত, যাদের রেমিট্যান্স ভারতীয় অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক স্বার্থও এই অঞ্চলের শান্তির ওপর নির্ভরশীল।
ইসরায়েল-ইরান সংঘাত ভারতের জন্য একদিকে যেমন কোটি কোটি টাকার ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে তেমনি বড় ধরনের ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জও এনেছে। প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি ও কৃষি খাতে ভারত লাভবান হলেও, জ্বালানি নিরাপত্তা, রপ্তানি, বিনিয়োগ ও কৌশলগত প্রকল্পগুলো এখন অনিশ্চয়তার মুখে। ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—এই কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রেখে অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা এবং পশ্চিম এশিয়ার অস্থির পরিস্থিতিতে নিরাপদভাবে এগিয়ে চলা।