Israel secret nuclear arsenal: ইসরায়েলের কাছে ঠিক কতটি পারমাণবিক বোমা রয়েছে—এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম আলোচিত ও রহস্যময় প্রশ্ন। যদিও ইসরায়েল কখনোই প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি যে তাদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, তবুও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়—ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র দেশ, যার হাতে কার্যত পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। বিভিন্ন সূত্র মতে, বর্তমানে ইসরায়েলের কাছে আনুমানিক ৮০ থেকে ৯০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড (বোমা) রয়েছে, তবে কিছু বিশেষজ্ঞ এই সংখ্যা ২০০ পর্যন্ত হতে পারে বলে মনে করেন।
১৯৬০-এর দশক থেকেই ইসরায়েলের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখা হচ্ছে। ইসরায়েল কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার বা অস্বীকার করেনি যে তাদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র আছে। বরং ‘নীতিগত অস্পষ্টতা’ (policy of ambiguity) বা ‘অস্পষ্টতা নীতি’ অনুসরণ করে দেশটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বারবার বলেছে, ‘ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রবর্তনকারী প্রথম দেশ হবে না’। এই নীতির ফলে ইসরায়েল কখনোই তার পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা, ক্ষমতা বা অবস্থান প্রকাশ করেনি এবং আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (IAEA) নিয়মিত পরিদর্শনের আওতায়ও তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো নেই।
ইসরায়েলের পারমাণবিক কর্মসূচির সূচনা হয়েছিল ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে, যখন ফ্রান্সের সহায়তায় দক্ষিণ ইসরায়েলের নেগেভ মরুভূমির ডিমোনা শহরে গড়ে ওঠে ‘নেগেভ পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র’। এখানেই মূলত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় প্লুটোনিয়াম উৎপাদন হয়। ১৯৮৬ সালে ডিমোনা চুল্লির একজন সাবেক টেকনিশিয়ান মোর্দেচাই ভানুনু ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে তথ্য ফাঁস করলে বিশ্বের সামনে ইসরায়েলের পারমাণবিক কর্মসূচির চিত্র আরও স্পষ্ট হয়4। ভানুনুর তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা করা হয়, সে সময় ইসরায়েলের হাতে ১০০ থেকে ২০০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড ছিল, যদিও পরবর্তীতে পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো এই সংখ্যা কমিয়ে ৮০ থেকে ৯০-এর মধ্যে নির্ধারণ করে।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ও গবেষণা সংস্থাগুলোর মতে, ইসরায়েলের কাছে আনুমানিক ৯০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে2734। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিউক্লিয়ার থ্রেট ইনিশিয়েটিভ (NTI) এবং সুইডেনভিত্তিক স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI) উভয়েই এই সংখ্যা উল্লেখ করেছে। এছাড়া, ইসরায়েলের হাতে প্রায় ৩০০টি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির মতো যথেষ্ট প্লুটোনিয়াম রয়েছে বলেও ধারণা করা হয়।
ইসরায়েল তার পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার বহন ও ব্যবহারের জন্য অত্যাধুনিক বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে। এর মধ্যে রয়েছে—
- এফ-১৬, এফ-১৫ এবং সর্বশেষ এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান, যা আকাশপথে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপে সক্ষম।
- ‘জেরিকো’ সিরিজের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, যা ৪,৮০০ থেকে ৬,৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্বে পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম।
- ডলফিন-শ্রেণির সাবমেরিন, যা সমুদ্রপথে পারমাণবিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করতে পারে।
এছাড়া, ইসরায়েলের হাতে ০.৮৫ টন প্লুটোনিয়াম ও ৩০০ কেজি উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে বলে ধারণা করা হয়, যা দিয়ে আরও অনেক পারমাণবিক বোমা তৈরি করা সম্ভব। তবে এসব তথ্যের অধিকাংশই অনুমাননির্ভর, কারণ ইসরায়েল কখনোই আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তাদের স্থাপনায় প্রবেশের অনুমতি দেয়নি।
ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিতর্ক রয়েছে। একদিকে, ইসরায়েল দাবি করে, তাদের অস্ত্রভাণ্ডার কেবলমাত্র ‘প্রতিরক্ষামূলক’ এবং ‘দমনের জন্য’ রাখা হয়েছে, বিশেষ করে ইরান ও আরব দেশগুলোর সম্ভাব্য হুমকির বিরুদ্ধে। অন্যদিকে, ইসরায়েল পারমাণবিক অস্ত্র নিরোধ চুক্তি (NPT)-তে স্বাক্ষর করেনি, ফলে তাদের কর্মসূচি আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে গেছে। এই পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার আশঙ্কা বাড়িয়েছে এবং ইরানসহ অন্যান্য দেশও পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া, ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে নৈতিক ও রাজনৈতিক বিতর্কও রয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন—একটি দেশ গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র রাখলে, অন্য দেশগুলো কেন পারবে না? এই দ্বৈতনীতি মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
সবশেষে বলা যায়, ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার নিয়ে যতই গোপনীয়তা থাকুক না কেন, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও গবেষকরা একমত—ইসরায়েলের হাতে বর্তমানে আনুমানিক ৯০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে এবং তাদের উৎপাদন ও সংরক্ষণ ক্ষমতা আরও বেশি। তবে এই অস্ত্রভাণ্ডার কতটা কার্যকর, কতটা আধুনিক এবং কখন, কীভাবে ব্যবহৃত হতে পারে—এসব প্রশ্ন আজও রহস্যাবৃত। তবুও, মধ্যপ্রাচ্যের কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা ভারসাম্যে ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী উপাদান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।