জগদ্ধাত্রী পুজো ২০২৫: দিনক্ষণ, ইতিহাস ও বিশেষত্ব – এক সম্পূর্ণ নির্দেশিকা

২০২৫ সালে জগদ্ধাত্রী পুজো কবে? এই প্রশ্নটি উৎসবপ্রেমী বাঙালির মনে এখন থেকেই উঁকি দিতে শুরু করেছে। দুর্গাপুজো এবং কালীপুজোর রেশ কাটতে না কাটতেই বাঙালি মেতে ওঠে জগতের ধাত্রী অর্থাৎ মা…

Ishita Ganguly

 

২০২৫ সালে জগদ্ধাত্রী পুজো কবে? এই প্রশ্নটি উৎসবপ্রেমী বাঙালির মনে এখন থেকেই উঁকি দিতে শুরু করেছে। দুর্গাপুজো এবং কালীপুজোর রেশ কাটতে না কাটতেই বাঙালি মেতে ওঠে জগতের ধাত্রী অর্থাৎ মা জগদ্ধাত্রীর আরাধনায়। পঞ্জিকা অনুসারে, ২০২৫ সালে এই পুজো শুরু হচ্ছে ২৭ অক্টোবর, সোমবার, শ্রীশ্রীজগদ্ধাত্রী পুজোর ষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে। তবে মূল পুজো, অর্থাৎ নবমী তিথি নিয়ে এই বছর দুটি ভিন্ন পঞ্জিকার মধ্যে সামান্য মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। নবমী তিথি শুরু হচ্ছে ৩০ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার সকাল ১০:০৬ মিনিটে এবং শেষ হচ্ছে ৩১ অক্টোবর, শুক্রবার সকাল ১০:০৩ মিনিটে। ফলে, অধিকাংশ জায়গায় ৩০ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার নবমী পুজো অনুষ্ঠিত হবে। তবে, উৎসবের প্রাণকেন্দ্র চন্দননগরে, কেন্দ্রীয় পুজো কমিটি এই তিথির বিভাজনকে সম্মান জানিয়ে উৎসবকে পাঁচ দিনে প্রসারিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা দর্শনার্থীদের জন্য এক দারুণ খবর।

জগদ্ধাত্রী পুজো: এক গভীর তাৎপর্য

দেবী জগদ্ধাত্রী হলেন দেবী দুর্গারই অন্য এক রূপ, এক সত্ত্বগুণময়ী, শান্ত অথচ শক্তিশালী প্রকাশ। তাঁর আরাধনা কেবল একটি উৎসব নয়, এর পেছনে রয়েছে গভীর আধ্যাত্মিক ও পৌরাণিক তাৎপর্য।

পৌরাণিক উৎস: দেবতাদের অহংকার চূর্ণ

জগদ্ধাত্রী পুজোর সবচেয়ে প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনিটি কেনোপনিষদ-এ বর্ণিত আছে। গল্পটি হলো, মহিষাসুরকে বধ করার পর দেবতারা প্রচণ্ড অহংকারী হয়ে ওঠেন। তাঁরা ভাবতে শুরু করেন যে, এই বিজয় তাঁদের সম্মিলিত শক্তির ফল, দেবীর একার কৃতিত্ব নয়। তাঁদের এই দর্প চূর্ণ করতে দেবী এক তেজঃপুঞ্জ ‘যক্ষ’-এর রূপে আবির্ভূত হন।

তিনি দেবতাদের শক্তি পরীক্ষা করার জন্য তাঁদের সামনে একটি সামান্য তৃণখণ্ড (ঘাসের টুকরো) রাখেন।

  • অগ্নিদেব তাঁর সমস্ত দাহিকা শক্তি দিয়েও সেই তৃণকে দগ্ধ করতে ব্যর্থ হন।
  • বায়ুদেব তাঁর সর্বশক্তি দিয়েও সেই তৃণখণ্ডকে ওড়াতে পারলেন না।
  • দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর বজ্র দিয়েও সেটিকে ধ্বংস করতে পারলেন না।

অবশেষে দেবতারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন এবং তাঁদের অহংকার চূর্ণ হয়। তাঁরা উপলব্ধি করেন যে, তাঁদের সমস্ত শক্তির উৎস আসলে সেই পরব্রহ্ম, সেই আদিশক্তি। তখন সেই জ্যোতির্ময় যক্ষ নিজরূপে প্রকাশিত হন—তিনিই ছিলেন চতুর্ভুজা, সিংহবাহিনী দেবী উমা হৈমবতী বা জগদ্ধাত্রী। তিনি দেবতাদের বোঝালেন যে, তিনিই এই জগতের সমস্ত শক্তিকে ধারণ করে আছেন, তাই তিনি ‘জগৎ-ধাত্রী’।

দ্বিতীয় পৌরাণিক কাহিনি: করীন্দ্রাসুর বধ

অপর একটি মত, যা শ্রীশ্রীচণ্ডী এবং তন্ত্রে পাওয়া যায়, তা হলো দেবী জগদ্ধাত্রী করীন্দ্রাসুর নামক এক হস্তীরূপী অসুরকে বধ করেছিলেন। সংস্কৃতে ‘করী’ শব্দের অর্থ হাতি। এই করীন্দ্রাসুর দেবতাদের অহংকারের প্রতীক। দেবী সেই হাতিরূপী অসুরকে বধ করে তার ওপর দণ্ডায়মান সিংহের পৃষ্ঠে আসীন হন। এই কারণেই দেবী জগদ্ধাত্রীর মূর্তিতে দেখা যায়, তাঁর বাহন সিংহ একটি মৃত হাতির মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। দেবীর এই রূপকে ‘করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী’ (করীন্দ্রাসুর বধকারিণী) বলা হয়।

প্রতিমার তাৎপর্য

দেবী জগদ্ধাত্রীর মূর্তি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি ত্রিনয়না, চতুর্ভুজা এবং রক্তবস্ত্র পরিহিতা। তাঁর চার হাতে থাকে:

  1. শঙ্খ: নাদব্রহ্ম বা সৃষ্টির ধ্বনির প্রতীক।
  2. চক্র: সৃষ্টিরক্ষা ও কালচক্রের প্রতীক।
  3. ধনুক: সংকল্প বা ইচ্ছাশক্তির প্রতীক।
  4. বাণ: লক্ষ্যভেদ বা জ্ঞানশক্তির প্রতীক।

তাঁর গলায় নাগরূপী পৈতে বা যজ্ঞোপবীত দেখা যায়, যা তন্ত্রমতে কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণের প্রতীক। তিনি শান্ত, সমাহিত এবং রাজরাজেশ্বরী রূপে ভক্তদের অভয় প্রদান করেন।

জগদ্ধাত্রী পুজো ২০২৫: নির্ঘণ্ট ও তিথি বিশ্লেষণ

২০২৫ সালের জগদ্ধাত্রী পুজোর দিনক্ষণ নিয়ে যে সামান্য বিভ্রান্তি রয়েছে, তা তিথির সূক্ষ্ম গণনার ওপর নির্ভরশীল। এখানে একটি স্পষ্ট তালিকা দেওয়া হলো:

পুজো তারিখ (ইং) বার তিথি ও সময় (প্রায়)
ষষ্ঠী ২৭ অক্টোবর, ২০২৫ সোমবার ষষ্ঠী তিথির সূচনা, পুজোর আরম্ভ
সপ্তমী ২৮ অক্টোবর, ২০২৫ মঙ্গলবার সপ্তমী পুজো
অষ্টমী ২৯ অক্টোবর, ২০২৫ বুধবার অষ্টমী পুজো
নবমী ৩০ অক্টোবর, ২০২৫ বৃহস্পতিবার নবমী তিথি সকাল ১০:০৬ থেকে শুরু
দশমী ৩১ অক্টোবর, ২০২৫ শুক্রবার নবমী তিথি সকাল ১০:০৩ পর্যন্ত

তিথির বিভাজন ও তার প্রভাব

মূলত, হিন্দু পুজো তিথি অনুযায়ী হয়, ইংরেজি তারিখ অনুযায়ী নয়। ২০২৫ সালে নবমী তিথিটি দুটি দিনের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

  • ৩০ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার: এই দিন সকাল ১০:০৬-এ নবমী লাগছে, যা সারাদিন এবং সারারাত থাকছে। শাস্ত্রানুযায়ী, নবমীর মূল পুজো (বিশেষত কৃষ্ণনগরে যা দিনের বেলাতেই হয়) এই দিনেই সম্পন্ন হবে।
  • ৩১ অক্টোবর, শুক্রবার: এই দিন সকাল ১০:০৩ মিনিট পর্যন্ত নবমী তিথি থাকছে। কিছু পঞ্জিকা মতে, এই দিন দশমী ধরা হচ্ছে, আবার কিছু মতে নবমীর অংশবিশেষ পালন করা হতে পারে।

এই কারণেই চন্দননগরের মতো জায়গায়, যেখানে পুজো ঘিরে বিশাল আয়োজন থাকে, সেখানে উৎসবকে দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। চন্দননগর কেন্দ্রীয় জগদ্ধাত্রী পুজো কমিটি এই দুই পঞ্জিকার মতকেই সম্মান জানিয়ে পুজো ও দর্শন পর্বকে দীর্ঘায়িত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ভক্তদের জন্য অতিরিক্ত আনন্দের কারণ হবে।

নবমীর বিশেষ ত্রি-সন্ধ্যা পুজো

জগদ্ধাত্রী পুজোর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, অনেক জায়গায় (বিশেষত কৃষ্ণনগরে) নবমীর দিনেই সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী—এই তিন প্রহরের পুজো একসঙ্গে সম্পন্ন করা হয়। দেবীকে তিনটি ভিন্ন রূপে আরাধনা করা হয়:

  1. সকালের পুজো (সাত্ত্বিক রূপ): এই সময় দেবীকে কুমারী বা বালিকা রূপে পুজো করা হয়। তিনি ব্রহ্মারূপা, হংসবাহিনী এবং শ্বেতবর্ণা।
  2. মধ্যাহ্নের পুজো (রাজসিক রূপ): এই সময় দেবীকে যুবতী, রাজরাজেশ্বরী রূপে পুজো করা হয়। তিনি বিষ্ণুরূপা, গরুড়বাহিনী এবং নানা অলঙ্কারে ভূষিতা।
  3. সন্ধ্যার পুজো (তামসিক রূপ): এই সময় দেবীকে প্রৌঢ়া, সংহারকারিণী রূপে পুজো করা হয়। তিনি শিবরূপা, বৃষবাহিনী এবং উগ্রচণ্ডা।

এই ত্রি-সন্ধ্যা পুজো জীবনের তিনটি পর্যায় এবং জগতের তিনটি গুণের (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) প্রতীক।

পুজোর দুই পীঠস্থান: কৃষ্ণনগর ও চন্দননগর

পশ্চিমবঙ্গে জগদ্ধাত্রী পুজো প্রধানত দুটি শহরকে কেন্দ্র করে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছে—নদীয়ার কৃষ্ণনগর এবং হুগলির চন্দননগর। যদিও দুটির মেজাজ এবং ঐতিহ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।

কৃষ্ণনগর: যেখানে শুরু ইতিহাসের

জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলনের কৃতিত্ব দেওয়া হয় নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়-কে। ঐতিহাসিক আলেখ্য অনুযায়ী, ঘটনাটি ঘটেছিল আনুমানিক ১৭৬২-৬৪ সাল নাগাদ।

তৎকালীন বাংলার নবাব মীর কাসিম কর বা খাজনা বাকি পড়ার অভিযোগে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে মুর্শিদাবাদে বন্দি করেন। যখন তিনি মুক্তি পান, তখন দুর্গাপুজোর সময় পেরিয়ে গেছে। শারদীয়া উৎসবে অংশ নিতে না পেরে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত ও মনমরা হয়ে পড়েন। কথিত আছে, সেই রাতেই দেবী তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন এবং কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে তাঁর ‘জগদ্ধাত্রী’ রূপে পুজো করার নির্দেশ দেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সেই স্বপ্নাদেশ পেয়ে কৃষ্ণনগরে ফিরে এসে মহা ধুমধামের সঙ্গে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন। এইভাবেই কৃষ্ণনগর হয়ে ওঠে জগদ্ধাত্রী পুজোর আঁতুড়ঘর।

কৃষ্ণনগরের ‘বুড়িমা’: এক জীবন্ত কিংবদন্তি

কৃষ্ণনগরের পুজোগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো চাষাপাড়ার ‘বুড়িমা’। এই পুজো ১৭৭২ সালে শুরু হয়েছিল। ২০২৫ সালে এই পুজো ২৫৩তম বর্ষে পা দেবে।

  • ঐতিহ্য: ভক্তদের বিশ্বাস, বুড়িমার কাছে মানত করলে তা পূরণ হয়।
  • সাজ: দেবীকে প্রায় ১০ কেজি সোনার গহনা দিয়ে সাজানো হয়।
  • ২০২৫-এর নির্ঘণ্ট:  ২০২৫ সালে বুড়িমার পুজো ৩০ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হবে। ওই দিন ভোর ৫:৪৪ মিনিটে সপ্তমী, সকাল ১০:৩০-এ অষ্টমী এবং দুপুর ১টায় নবমী পুজো সম্পন্ন হবে।
  • বিসর্জন: কৃষ্ণনগরের বিসর্জন এক রাজকীয় ব্যাপার। বুড়িমার প্রতিমা কাঁধে করে প্রথমে রাজবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তারপর জলঙ্গী নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়।

চন্দননগর: আলো ও আভিজাত্যের শহর

কৃষ্ণনগরে পুজোর সূচনা হলেও, জগদ্ধাত্রী পুজো আজ বিশ্বখ্যাতি পেয়েছে চন্দননগরের হাত ধরে। কীভাবে এই পুজো ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরে এল, তা নিয়ে দুটি মত আছে। একটি মতে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বন্ধু, চন্দননগরের ফরাসি দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী এখানে পুজোর সূচনা করেন। অন্য মতে, রাজার দেওয়ান দাতারাম সুর ভদ্রেশ্বরে এই পুজোর প্রচলন করেন, যা পরে চন্দননগরে ছড়িয়ে পড়ে। চাউলপট্টির ‘আদি মা’-এর পুজো ৩০০ বছরেরও প্রাচীন বলে মনে করা হয়।

চন্দননগরের পুজোর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হলো:

১. সুবিশাল প্রতিমা ও ডাকের সাজ

কৃষ্ণনগরের প্রতিমা মাঝারি আকারের এবং ঐতিহ্যবাহী হলেও, চন্দননগরের প্রতিমাগুলি উচ্চতায় প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ ফুট পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এই বিশাল প্রতিমাগুলি মূলত ঐতিহ্যবাহী শোলার সাজ এবং ডাকের সাজ (ধাতব ফয়েল) দিয়ে সজ্জিত করা হয়, যা এক অনবদ্য শিল্পনৈপুণ্যের নিদর্শন।

২. জগদ্বিখ্যাত আলোকসজ্জা

চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রধান আকর্ষণ হলো তার আলোকসজ্জা। গেট বেঙ্গল (Get Bengal) অনুযায়ী, একসময়কার টুনি বাল্বের ম্যাজিক এখন আধুনিক এলইডি লাইটের যুগে প্রবেশ করে নতুন মাত্রা পেয়েছে। এখানকার শিল্পীরা আলোর মাধ্যমে জীবন্ত গল্প, চলমান দৃশ্য এবং সামাজিক বার্তা ফুটিয়ে তোলেন, যা দেখতে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় হয়।

৩. কেন্দ্রীয় কমিটি ও ব্যবস্থাপনা

চন্দননগরের পুজো অত্যন্ত সুসংগঠিত। চন্দননগর কেন্দ্রীয় জগদ্ধাত্রী পুজো কমিটি প্রায় ১৩২ থেকে ১৯০টিরও বেশি পুজো কমিটিকে একত্রিত করে সমগ্র উৎসবটি পরিচালনা করে। এই একতা এবং শৃঙ্খলা চন্দননগরের পুজোকে এক আলাদা উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

৪. বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ও বিসর্জন

চন্দননগরের পুজোর সমাপ্তি ঘটে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে। এই শোভাযাত্রাকে অনেকে রিও কার্নিভালের পর বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম বলে মনে করেন। ২০২৫ সালে, এই শোভাযাত্রা ১ নভেম্বর, শনিবার অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে (সূত্র: আজতক বাংলা)। বিশাল বিশাল প্রতিমাগুলিকে সুসজ্জিত ট্রাকে চাপিয়ে, আলোর রোশনাই এবং বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে সারা শহর পরিক্রমা করানো হয়, যা এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য।

পুজোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব

জগদ্ধাত্রী পুজো কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষত হুগলি ও নদীয়া জেলার এক বিশাল অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি।

এক হাইপার-লোকাল অর্থনীতি

যদিও বিশ্বব্যাঙ্ক (World Bank) বা ফোর্বস (Forbes)-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি এই নির্দিষ্ট উৎসবের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে সরাসরি কোনো পরিসংখ্যান প্রকাশ করে না, তবে এর স্থানীয় প্রভাব অনস্বীকার্য। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে কয়েকশো কোটি টাকার এক ‘হাইপার-লোকাল’ অর্থনীতি আবর্তিত হয়।

  • শিল্পী ও কারিগর: কুমোরটুলির মৃৎশিল্পী থেকে শুরু করে চন্দননগরের স্থানীয় শিল্পী, শোলার কারিগর, ডাকের সাজের শিল্পী এবং বিশেষত আলোকসজ্জার সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার ইলেকট্রিশিয়ান ও শিল্পী এই উৎসবের ওপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল।
  • স্থানীয় ব্যবসা: পুজোর এই ৪-৫ দিন ধরে স্থানীয় দোকান, রেস্তোরাঁ, পরিবহন ব্যবস্থা এবং হকারদের ব্যবসা তুঙ্গে থাকে। লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থীর আগমনে স্থানীয় বাণিজ্য এক নতুন গতি পায়।
  • উৎসব পর্যটন: যদিও এটি আন্তর্জাতিক পর্যটকদের সেভাবে আকর্ষণ করে না, তবে এটি পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরীণ পর্যটনের (Domestic Tourism) এক বিরাট উদাহরণ। ভারতের পর্যটন মন্ত্রক (Ministry of Tourism, Government of India)-এর পশ্চিমবঙ্গ সংক্রান্ত রিপোর্ট (যদিও এটি ২০১৪-১৫ সালের) বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাজ্যের পর্যটন মূলত অভ্যন্তরীণ এবং বন্ধু-আত্মীয়দের কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। জগদ্ধাত্রী পুজো এর এক सटीक উদাহরণ, যেখানে কলকাতা, হাওড়া, বর্ধমান ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলি থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই উৎসবে সামিল হন।

সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মেলবন্ধন

এই পুজো কমিটিগুলি শুধু উৎসবে নয়, সারা বছর ধরে সামাজিক কাজেও যুক্ত থাকে। এর এক উজ্জ্বল উদাহরণ হলো চন্দননগরের হেলাপুকুর ধর পুজো কমিটি।এই কমিটি স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি (SMA)-তে আক্রান্ত এক শিশুর চিকিৎসার জন্য গণ-তহবিল থেকে ৮৫,০০০ টাকা সংগ্রহ করে তার পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে এই উৎসবগুলি নিছক বিনোদন নয়, এগুলি সামাজিক বন্ধন ও মানবিকতার এক শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম।

জগদ্ধাত্রী পুজো হলো অহংকারকে বিনাশ করে জগতের প্রতিপালনের উৎসব। এটি ভক্তি, ইতিহাস, শিল্প এবং অর্থনীতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন। ২০২৫ সালের এই উৎসব, বিশেষত চন্দননগরের পাঁচ দিনব্যাপী আয়োজনের ফলে, এক নতুন মাত্রা পেতে চলেছে। তা সে কৃষ্ণনগরের রাজকীয় ঐতিহ্য ও ‘বুড়িমা’-র প্রতি ভক্তিই হোক, বা চন্দননগরের আলোর রোশনাই ও গগনচুম্বী প্রতিমার বিস্ময়—মা জগদ্ধাত্রীর আরাধনা বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবগুলির মধ্যে অন্যতম হয়ে থাকবে।

About Author
Ishita Ganguly

ঈশিতা গাঙ্গুলী ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি (IGNOU) থেকে স্নাতক। তিনি একজন উদ্যমী লেখক এবং সাংবাদিক, যিনি সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ ও অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে থাকেন। ঈশিতার লেখার ধরন স্পষ্ট, বস্তুনিষ্ঠ এবং তথ্যবহুল, যা পাঠকদের মুগ্ধ করে। তার নিবন্ধ ও প্রতিবেদনের মাধ্যমে তিনি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সামনে আনেন এবং পাঠকদের চিন্তা-চেতনার পরিসরকে বিস্তৃত করতে সহায়তা করেন। সাংবাদিকতার জগতে তার অটুট আগ্রহ ও নিষ্ঠা তাকে একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি দিয়েছে, যা তাকে ভবিষ্যতে আরও সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে।