Jagannath Yatra schedule: ভগবান জগন্নাথের মহিমান্বিত রথযাত্রা ২০২৫ শুরু হয়ে গেছে এবং লাখো ভক্তের হৃদয়ে উৎসবের আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে। এই বিশ্বব্যাপী খ্যাতিসম্পন্ন উৎসব স্নান পূর্ণিমার মাধ্যমে শুরু হয়েছে এবং আগামী জুলাই পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে এই পবিত্র অনুষ্ঠানটি প্রতি বছর অসংখ্য দেশি-বিদেশি তীর্থযাত্রীদের আকর্ষণ করে। রথযাত্রার এই অনন্য উৎসবটি কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি সামাজিক সমতা, ভ্রাতৃত্ব এবং ঐক্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত।
স্নান পূর্ণিমা দিয়ে Jagannath Rath Yatra 2025 এর সূচনা
জগন্নাথ রথযাত্রা ২০২৫ এর প্রথম পর্ব স্নান পূর্ণিমার মাধ্যমে শুরু হয়েছে ১১ জুন, ২০২৫ তারিখে। এই পবিত্র দিনে ভগবান জগন্নাথ, বলভদ্র এবং দেবী সুভদ্রার ত্রিমূর্তিকে পবিত্র স্নানযাত্রায় অংশগ্রহণ করানো হয়েছে। স্নান মণ্ডপে দেবতাদের প্রকাশ্যে আনা হয় এবং মন্দিরের সোনালি কূপ থেকে আনা ১০৮টি কলসি পবিত্র জল দিয়ে তাদের স্নান করানো হয়।
এই বিশেষ অনুষ্ঠানটি বছরের একমাত্র সময় যখন তিনটি প্রধান দেবতাকে একসাথে জনসমক্ষে উপস্থাপন করা হয়। হাজার হাজার ভক্ত এই দুর্লভ দর্শনের জন্য পুরীতে সমবেত হয়েছেন। স্নানযাত্রার পর দেবতারা অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে বিশ্বাস করা হয় এবং তারা পরবর্তী ১৫ দিন অনাবসর নামক নির্জনবাসে থাকেন।
রথযাত্রার সম্পূর্ণ সূচি এবং তারিখসমূহ
Jagannath Rath Yatra 2025 একটি দীর্ঘ উৎসব যা বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত। এই নয় দিনব্যাপী মহোৎসবের বিস্তারিত সূচি নিম্নরূপ:
স্নান পূর্ণিমা: ১২ জুন, ২০২৫
অনাবসর (বিশ্রামকাল): ১৩-২৬ জুন, ২০২৫
গুণ্ডিচা মার্জনা (মন্দির পরিষ্কার): ২৬ জুন, ২০২৫
রথযাত্রা: ২৭ জুন, ২০২৫
হেরা পঞ্চমী: ১ জুলাই, ২০২৫
বাহুড়া যাত্রা (প্রত্যাবর্তন যাত্রা): ৪ জুলাই, ২০২৫
সুনা বেশ (স্বর্ণালঙ্কার): ৫ জুলাই, ২০২৫
নীলাদ্রি বিজয় (মূল মন্দিরে প্রত্যাবর্তন): ৫ জুলাই, ২০২৫
আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রার মূল অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এই বছর দ্বিতীয়া তিথি ২৬ জুন বিকেল ১:২৫ মিনিটে শুরু হয়ে ২৭ জুন সকাল ১১:১৯ মিনিটে শেষ হবে।
রথযাত্রার প্রধান আচার-অনুষ্ঠান
পাহান্ডি বিজে অনুষ্ঠান
রথযাত্রার দিন সকালে মঙ্গল আরতির মাধ্যমে শুরু হয় পবিত্র অনুষ্ঠান। এরপর পাহান্ডি বিজে নামক মহাশোভাযাত্রায় দেবতাদের গর্ভগৃহ থেকে বের করে আনা হয়। ভক্ত ও পুরোহিতরা মিলে স্তোত্র, ঢোল, কাঁসর ও শঙ্খের মাধুর্যময় ধ্বনির সাথে দেবতাদের রথে তুলে দেন।
ছেড়া পাহাড়া রীতি
রথযাত্রার অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ অনুষ্ঠান হল ছেড়া পাহাড়া। পুরীর গজপতি রাজা, যিনি ভগবান জগন্নাথের প্রথম সেবক হিসেবে বিবেচিত, স্বর্ণ ঝাড়ু দিয়ে তিনটি রথ পরিষ্কার করেন এবং চন্দন জল ছিটিয়ে দেন। এই রীতিটি সামাজিক সমতার বার্তা প্রদান করে যে ঈশ্বরের কাছে সকলেই সমান।
রথের বিশেষত্ব
প্রতিটি দেবতার জন্য আলাদা রথ রয়েছে। ভগবান জগন্নাথের রথ নন্দীঘোষে ১৮টি চাকা, বলভদ্রের রথ তালধ্বজে ১৬টি চাকা এবং দেবী সুভদ্রার রথ দর্পদলনে ১৪টি চাকা রয়েছে। প্রতিটি রথ কাঠের তৈরি এবং অত্যন্ত শিল্পকর্ম দ্বারা সুশোভিত।
গুণ্ডিচা মন্দিরে সাত দিনের অবস্থান
রথযাত্রার মূল অনুষ্ঠানে হাজার হাজার ভক্ত একসাথে রথ টানেন। গ্র্যান্ড রোড দিয়ে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে দেবতারা গুণ্ডিচা মন্দিরে পৌঁছান। এই মন্দিরটি দেবতাদের মাসিমার বাড়ি হিসেবে পরিচিত। এখানে তারা সাত দিন অবস্থান করেন এবং ভক্তরা তাদের দর্শন ও পূজা-অর্চনা করার সুযোগ পান।
হেরা পঞ্চমী এবং দেবী লক্ষ্মীর আগমন
গুণ্ডিচা মন্দিরে অবস্থানের পঞ্চম দিনে হেরা পঞ্চমী অনুষ্ঠিত হয়। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী, ভগবান জগন্নাথের স্ত্রী দেবী লক্ষ্মী তাকে খুঁজতে গুণ্ডিচা মন্দিরে আসেন। তিনি তার স্বামীকে একা রেখে ভাই-বোনের সাথে চলে যাওয়ার জন্য অভিমান প্রকাশ করেন। তখন ভগবান জগন্নাথ তাকে আগ্ঞানমালা প্রদান করে শান্ত করেন।
বাহুড়া যাত্রা এবং প্রত্যাবর্তন
সাত দিন পর বাহুড়া যাত্রার মাধ্যমে দেবতারা মূল মন্দিরে ফিরে আসেন। এই প্রত্যাবর্তন যাত্রাও রথযাত্রার মতোই জাঁকজমকপূর্ণ। ফেরার পথে রথগুলি মৌসি মা মন্দিরে (দেবী অর্ধশিনী মন্দির) থামে, যেখানে দেবতাদের পোড়া পিঠা নামক ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি পরিবেশন করা হয়।
সুনা বেশ এবং নীলাদ্রি বিজয়
বাহুড়া যাত্রার পরদিন সুনা বেশ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তিন দেবতাকে স্বর্ণালঙ্কারে সাজানো হয়। এটি একটি অসাধারণ দৃশ্য যা দেখার জন্য হাজার হাজার ভক্ত উপস্থিত হন। অবশেষে নীলাদ্রি বিজয়ের মাধ্যমে দেবতারা তাদের গর্ভগৃহে ফিরে যান, যা রথযাত্রার সমাপ্তি চিহ্নিত করে।
Jagannath Rath Yatra 2025 এর বৈশ্বিক তাৎপর্য
জগন্নাথ রথযাত্রা শুধুমাত্র ভারতেই নয়, বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। ১৯৬৭ সালে এ.সি. ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের হাত ধরে সান ফ্রান্সিসকোতে প্রথম ভারতের বাইরে রথযাত্রা উৎসব শুরু হয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই উৎসব পালিত হয়।
নিউইয়র্কে রথযাত্রা ২০২২ সালে তার ৫০তম বার্ষিকী পালন করেছে, যা এই উৎসবের স্থায়িত্ব এবং বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ। প্রতিটি দেশে স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে মিশে এই উৎসব তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে।
উৎসবের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক বার্তা
রথযাত্রা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি সামাজিক সমতা ও ঐক্যের প্রতীক। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ রথ টানতে পারেন এবং ভগবানের কৃপা লাভ করতে পারেন। এই উৎসব মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে এবং সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি করে।
রথযাত্রার মাধ্যমে ভগবান জগন্নাথ তার গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে আসেন। এটি প্রতীকী অর্থে দেখায় যে ঈশ্বর সকল ভক্তের কাছে সমানভাবে পৌঁছে যান এবং কোনো ভেদাভেদ করেন না।
জগন্নাথ রথযাত্রা ২০২৫ একটি অভূতপূর্ব আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এই মহোৎসব আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং আধ্যাত্মিকতার সাথে গভীর সংযোগ স্থাপনের একটি বিরল সুযোগ। প্রতি বছরের মতো এবারও লাখো ভক্ত পুরীতে সমবেত হবেন এবং ভগবান জগন্নাথের কৃপা লাভের জন্য রথ টানায় অংশগ্রহণ করবেন। এই পবিত্র যাত্রা কেবল একটি উৎসব নয়, বরং মানবতার একটি উদযাপন যা আমাদের সকলকে একসূত্রে বেঁধে রাখে।