উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ের আচমকা পদত্যাগ নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মহলে তীব্র জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। সোমবার (২১ জুলাই) রাতে স্বাস্থ্যের কারণ দেখিয়ে ইস্তফা দেওয়া ধনখড়ের এই সিদ্ধান্তে মঙ্গলবার সকালেই রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। তবে বিরোধী দলগুলো এই হঠাৎ সিদ্ধান্তের পেছনে স্বাস্থ্যের চেয়ে অন্য কারণ রয়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে।
সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনের প্রথম দিনেই এই চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে। সোমবার সকাল ১১টায় যথারীতি রাজ্যসভার অধিবেশন পরিচালনা করেন ধনখড়। কিন্তু দুপুর ১২টার পর তিনি আর সভায় ফিরে আসেননি এবং রাতে রাষ্ট্রপতির কাছে ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দেন। এই আকস্মিক পদত্যাগ নিয়ে কংগ্রেস থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিরোধী দল প্রশ্ন তুলেছে।
কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি তথা রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খড়্গে সংশয় প্রকাশ করে বলেছেন, “কী কারণ, তা একমাত্র তিনিই (ধনখড়ই) জানেন। এই নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। হয় তিনি জানেন, নয়তো সরকার জানে।” শিবসেনা (উদ্ধব)-র রাজ্যসভার সাংসদ সঞ্জয় রাউত আরও স্পষ্ট করে বলেছেন যে স্বাস্থ্যের কারণে ইস্তফা, এই তত্ত্ব তিনি মানতে নারাজ। তাঁর মতে, “এর নেপথ্য রাজনীতির কোন খেলা রয়েছে, তা শীঘ্রই প্রকাশ্যে চলে আসবে।”
বিরোধী সাংসদরা জানিয়েছেন যে সোমবার দিনভর ধনখড়কে সুস্থ এবং স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ অখিলেশ প্রসাদ বলেছেন, সোমবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ধনখড়ের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল এবং তখন তাঁকে বেশ খোশমেজাজেই দেখাচ্ছিল। একইভাবে শিবসেনার প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদীও জানিয়েছেন যে সোমবার ঠিকঠাকই দেখাচ্ছিল ধনখড়কে।
রাজনৈতিক মহলে আরেকটি তত্ত্ব প্রচলিত হয়েছে যে, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে ধনখড়ের মতানৈক্য বা উপেক্ষার কারণেই এই পদত্যাগ। বেশ কয়েকটি সূত্রের খবর অনুযায়ী, সোমবার ধনখড়ের ডাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা এবং কেন্দ্রীয় সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু অনুপস্থিত ছিলেন। এই ঘটনায় ধনখড় অসন্তুষ্ট এবং অসম্মানিত বোধ করেছেন বলে কংগ্রেস দাবি করেছে।
কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ জয়রাম রমেশ এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে বলেছেন, “নাড্ডা এবং রিজিজুর জন্য দীর্ঘ ক্ষণ অপেক্ষা করা হয়। কিন্তু ওঁরা বৈঠকে আসেননি। দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী যে আসছেন না, তা নিয়ে জগদীপ ধনখড়কে কিছু জানানো হয়নি আলাদা ভাবে।” জয়রামের মতে, সোমবার দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৪.৩০টের মধ্যে এমন কিছু ঘটেছে যার কারণে ধনখড় সরাসরি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
অন্যদিকে, ধনখড় নিজে তাঁর পদত্যাগপত্রে স্পষ্টভাবে শারীরিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রপতিকে লেখা চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন, “স্বাস্থ্যের কারণে চিকিৎসকদের পরামর্শেই উপরাষ্ট্রপতি পদ থেকে তিনি ইস্তফা দিচ্ছেন।” এই বছরের শুরুতে তিনি হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য এইমসে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন যে ২০২৭ সালে তাঁর কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেই তিনি অবসর নেবেন।
বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটও এই আচমকা সিদ্ধান্তে বিস্মিত হয়েছে। একটি শীর্ষ বিজেপি নেতা জানিয়েছেন, “আমরা এখনও গোটা বিষয়টি নিয়ে ভাবছি। তবে আমি বিশ্বাস করি দল এমন কাউকে বেছে নেবে যিনি অভিজ্ঞ এবং গ্রহণযোগ্য।” রাজ্যসভার উপ-সভাপতি হরিবংশ নারায়ণ সিংহের নামও নতুন উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে আলোচনায় এসেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে ধনখড়ের এই পদত্যাগ কেবল ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের বিষয় নয়, বরং এর পেছনে গভীর রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। তাঁর উপরাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বিরোধীদের সাথে ঘন ঘন বাকবিতণ্ডা এবং তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার চেষ্টা করেছিল বিরোধী দলগুলো। এমকে স্ট্যালিনের ডিএমকে-র সাংসদ টিআর বালুও দাবি করেছেন যে ‘চাপের কারণেই’ ইস্তফা দিয়েছেন ধনখড়।
কংগ্রেসের আরেক রাজ্যসভার সাংসদ সৈয়দ নাসির হোসেন প্রশ্ন তুলেছেন যে ধনখড়কে বাধ্য করা হয়েছে কিনা ইস্তফা দিতে। তিনি বলেছেন, “গতকাল পর্যন্তও তিনি (ধনখড়) রাজ্যসভার কাজকর্মে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি কি নিজেই ইস্তফা দিলেন, নাকি তাঁকে বাধ্য করা হয়েছে, এটি প্রকাশ্যে আসা উচিত।”
উল্লেখ্য যে জগদীপ ধনখড় ২০২২ সালের আগস্ট মাসে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। বিরোধী শিবিরের প্রার্থী মার্গারেট আলভাকে ৩৪৬ ভোটে হারিয়ে তিনি এই পদে আসীন হন। ইতিপূর্বে তিনি ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন এবং সেই সময় থেকেই তিনি বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত।
এর আগে শুধুমাত্র ভি.ভি. গিরি এবং আর. ভেঙ্কটরামন উপরাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন, তবে তাঁরা রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে লড়ার জন্য পদত্যাগ করেছিলেন এবং দুজনেই পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। কিন্তু ধনখড়ের ক্ষেত্রে সেরকম কোনো সুযোগ নেই, কারণ বর্তমান রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর মেয়াদ ২০২৭ সালের ২২ জুলাই পর্যন্ত।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ধনখড়ের পদত্যাগের ১৫ ঘণ্টা পর টুইট করেছেন। এই বিলম্বিত প্রতিক্রিয়াও রাজনৈতিক মহলে আলোচনার বিষয় হয়েছে। সরকার বা উপরাষ্ট্রপতির অফিস থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ না করায় জল্পনার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
মঙ্গলবার সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে ধনখড় অনুপস্থিত ছিলেন এবং পরে জানা যায় যে রাষ্ট্রপতি তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। এখন প্রশ্ন উঠেছে যে নতুন উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য সরকার কী পদক্ষেপ নেবে এবং কে হবেন পরবর্তী উপরাষ্ট্রপতি।
জগদীপ ধনখড়ের এই আকস্মিক পদত্যাগ ভারতীয় রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় এনেছে। স্বাস্থ্যের কারণ হোক বা রাজনৈতিক চাপের কারণ হোক, এই ঘটনা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং আগামী দিনে এর প্রভাব কেমন হবে তা দেখার বিষয়।