ভারতীয় মহাকাশ অনুসন্ধানের ইতিহাসে আরেকটি উজ্জ্বল অধ্যায় যুক্ত হতে চলেছে। অন্ধ্রপ্রদেশের পালাকোল্লু থেকে আসা ২৩ বছর বয়সী জাহ্নবী ডাঙ্গেতি আগামী ২০২৯ সালে টাইটান্স স্পেস ইন্ডাস্ট্রিজের মিশনে অংশ নিয়ে মহাকাশে পাড়ি জমাতে চলেছেন। গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্লার পর এই তরুণী হবেন পরবর্তী ভারতীয় যিনি মহাকাশযাত্রার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করবেন। নাসার প্রেস্টিজিয়াস ইন্টারন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস প্রোগ্রাম (আইএএসপি) সম্পন্ন করা প্রথম ভারতীয় হিসেবে জাহ্নবী ইতিমধ্যেই দেশের গর্বের কারণ হয়ে উঠেছেন।
পশ্চিম গোদাবরী জেলার পালাকোল্লুতে জন্মগ্রহণকারী জাহ্নবী ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন পাঞ্জাবের লাভলি প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে। তার বাবা-মা শ্রীনিবাস ও পদ্মশ্রী বর্তমানে কুয়েতে কর্মরত রয়েছেন এবং দূর থেকেই তাদের কন্যার মহাকাশ অভিযানের স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করে আসছেন।
টাইটান্স স্পেস ইন্ডাস্ট্রিজের এই যুগান্তকারী মিশনটি পাঁচ ঘণ্টা স্থায়ী হবে এবং এই সময়ে নভোচারীরা পৃথিবীর চারপাশে দুইবার প্রদক্ষিণ করবেন। এই অভিযানের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ দিক হলো যে, তারা দুটি সূর্যোদয় ও দুটি সূর্যাস্ত প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাবেন। পুরো মিশনে প্রায় তিন ঘণ্টা ধারাবাহিক শূন্য মাধ্যাকর্ষণের অভিজ্ঞতা লাভ হবে, যা বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও মানব মহাকাশযাত্রার উন্নতির জন্য একটি বিপ্লবী পরিবেশ সৃষ্টি করবে।
NASA-র পর্দার আড়ালের জগৎ: ৭টি গোপন মিশন যা আপনাকে অবাক করবে!
এই মিশনের নেতৃত্বে থাকবেন প্রবীণ নাসা নভোচারী ও অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন সেনাবাহিনীর কর্নেল উইলিয়াম ম্যাকআর্থার জুনিয়র, যিনি বর্তমানে টাইটান্স স্পেসের চিফ অ্যাস্ট্রোনট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার অধীনে জাহ্নবী ২০২৬ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী তিন বছর ধরে নিবিড় নভোচারী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবেন। এই প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত থাকবে মহাকাশযানের সিস্টেম পরিচালনা, ফ্লাইট সিমুলেশন, জরুরি অবস্থায় বেঁচে থাকার কৌশল এবং চিকিৎসা মূল্যায়ন।
জাহ্নবীর মহাকাশ অভিযানের প্রস্তুতি কিন্তু এখনই শুরু হয়নি। বছরের পর বছর ধরে তিনি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (স্টেম) শিক্ষায় সক্রিয়ভাবে জড়িত রয়েছেন এবং মহাকাশ গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তিনি শূন্য মাধ্যাকর্ষণ পরিবেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন, উচ্চ উচ্চতার মিশনে অংশ নিয়েছেন, স্পেস স্যুট পরিচালনা এবং গ্রহীয় সিমুলেশনে দক্ষতা অর্জন করেছেন। তার অর্জনের তালিকায় রয়েছে ২০২২ সালে পোল্যান্ডের এএটিসিতে সর্বকনিষ্ঠ বিদেশি অ্যানালগ অ্যাস্ট্রোনট হওয়ার গৌরব।
আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুসন্ধান সহযোগিতায় (আইএএসসি) তার অংশগ্রহণ তাকে আরও পরিচিত করে তুলেছে। নাসা সমর্থিত এই প্রোগ্রামে হাওয়াইয়ের প্যান-স্টারস টেলিস্কোপ ব্যবহার করে তিনি গ্রহাণু আবিষ্কারে অবদান রেখেছেন। রিয়েল-টাইম জ্যোতির্বিজ্ঞান তথ্য ব্যবহার করে তার দল প্রাথমিক গ্রহাণু আবিষ্কারে সফল হয়েছে, যা তার বৈজ্ঞানিক দক্ষতার প্রমাণ।
স্পেস আইসল্যান্ডের ভূতত্ত্ব প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে নির্বাচিত প্রথম ভারতীয় হিসেবেও জাহ্নবী ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। এই বিশেষায়িত প্রশিক্ষণে পৃথিবীর মঙ্গলের মতো পরিবেশে ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা ভবিষ্যতের আন্তঃগ্রহীয় মিশনের জন্য বিজ্ঞানীদের প্রস্তুত করে। তিনি অ্যাডভান্সড অ্যাডভেঞ্চার স্কুবা ডাইভার হিসেবেও প্রশিক্ষিত, যা চরম পরিবেশে কাজ করার তার সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে।
জাহ্নবীর অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জে পিপলস চয়েস অ্যাওয়ার্ড, ইসরোর ওয়ার্ল্ড স্পেস উইকে ইয়াং অ্যাচিভার অ্যাওয়ার্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারের বিশেষ কৃতিত্ব পুরস্কার এবং ইন্ডিয়ান বুক অব রেকর্ডসে বহুপ্রতিভাবান কন্যা হিসেবে স্বীকৃতি তার সাফল্যের প্রমাণ।
শিক্ষাক্ষেত্রে তার অবদানও কম নয়। ইসরোর শিক্ষামূলক প্রোগ্রামে বক্তৃতা প্রদান, সারাদেশের জাতীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এনআইটি) শিক্ষার্থীদের সামনে ভাষণ দেওয়া এবং অ্যানালগ মিশন, গভীর সমুদ্র ডাইভিং ও গ্রহীয় বিজ্ঞান সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নিয়মিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি স্টেম শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন।
গগনযান মিশন ২০২৪: ভারতের মহাকাশ অভিযানের অজানা রহস্য ফাঁস!
টাইটান্স স্পেস ইন্ডাস্ট্রিজের এই মিশনটি কেবল একটি মহাকাশ ভ্রমণ নয়, বরং বাণিজ্যিক মহাকাশ অনুসন্ধানে একটি নতুন মাত্রা যোগ করতে চলেছে। কোম্পানিটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য স্পেসপ্লেন এবং টাইটান্স অরবিটাল পোর্ট স্পেস স্টেশন (টপস) উন্নয়নের মাধ্যমে মহাকাশ ভ্রমণকে আরও সহজলভ্য করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে7। তাদের একক-পর্যায়ের কক্ষপথ (এসএসটিও) ডিজাইন ঐতিহ্যবাহী বহু-পর্যায়ের রকেটের তুলনায় পরিচালনা দক্ষতা বৃদ্ধি ও খরচ কমানোর সুবিধা প্রদান করে।
জাহ্নবীর এই অভিযান শুধু তার ব্যক্তিগত স্বপ্ন পূরণ নয়, বরং সমগ্র ভারতের জন্য গৌরবের বিষয়। তিনি তার ইনস্টাগ্রাম পোস্টে লিখেছেন যে, তিনি তার ভারতীয় শেকড়ের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে গর্বিত এবং এই মিশনটি সেই সকল তরুণ স্বপ্নদর্শীদের জন্য যারা আকাশের দিকে তাকিয়ে অসম্ভবকে কল্পনা করে। তার এই যাত্রা নিঃসন্দেহে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হবে এবং ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।