Jamaat-e-Islami: বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিদৃশ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। দীর্ঘ ১৩ বছর পর জামাত-ই-ইসলামী বাংলাদেশ তাদের ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয় পুনরায় খুলেছে। এই ঘটনা ঘটেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং দেশ ত্যাগের পর। মঙ্গলবার (৬ আগস্ট ২০২৪) জামাতের নেতৃবৃন্দ মগবাজারে অবস্থিত তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করেন।
জামাতের মুখপাত্র আতাউর রহমান সরকার জানিয়েছেন, ২০১১ সালে তাদের পার্টি অফিস জোরপূর্বক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও তা পুনরায় খোলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
Jamaat-Shibir Ban News: সরকারের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক পরিচয় হারালো কট্টর ইসলামী সংগঠন
জামাত-ই-ইসলামী বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল। ১ আগস্ট ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট জামাত-ই-ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে, এই যুক্তিতে যে দলটি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য। এরপর ১ আগস্ট ২০২৪ সালে সরকার দলটিকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
জামাত-ই-ইসলামীর পূর্বসূরি, জামাত-ই-ইসলামী পাকিস্তান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং পাকিস্তানের বিভাজনের বিরোধিতা করেছিল। ১৯৭১ সালে, দলটির সাথে সম্পর্কিত অধাসামরিক বাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ও বুদ্ধিজীবীদের গণহত্যায় অংশ নেয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, নতুন সরকার জামাত-ই-ইসলামীকে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ থেকে নিষিদ্ধ করে, কারণ সরকার ধর্মনিরপেক্ষ ছিল এবং দলটির কিছু নেতা পাকিস্তানে নির্বাসনে চলে যান। ১৯৭৫ সালে প্রথম রাষ্ট্রপতির হত্যাকাণ্ড এবং সামরিক অভ্যুত্থানের পর, জামাতের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় এবং নতুন দল জামাত-ই-ইসলামী বাংলাদেশ গঠিত হয়। নির্বাসিত নেতাদের ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হয়।
বাংলাদেশি ইউটিউবারের অবৈধ ভারত প্রবেশের ভিডিও ভাইরাল, উদ্বেগ বাড়ল
জামাত-ই-ইসলামীর এজেন্ডা হল শরিয়া আইন ব্যবস্থা সহ একটি “ইসলামী রাষ্ট্র” প্রতিষ্ঠা করা এবং “অ-ইসলামী” অনুশীলন ও আইন নিষিদ্ধ করা। এই কারণে, তারা তাদের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক ধারণা “ইকামত-এ-দীন” কে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হিসেবে ব্যাখ্যা করে।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে, জামাত-ই-ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেখা গেছে যা শেখ হাসিনার পতনের দিকে নিয়ে গেছে। দলটির ছাত্র শাখা, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও পুনরায় খোলা হয়েছে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন সোমবার সকল দলের সাথে আলোচনা করেন এবং ঘোষণা করেন যে জুলাই মাস থেকে গ্রেফতার হওয়া রাজনৈতিক কর্মী, নেতা ও কর্মীদের মুক্তি দেওয়া হবে। মঙ্গলবার শতাধিক ব্যক্তিকে জামিন দেওয়া হয়েছে।
প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেত্রী খালেদা জিয়াকেও মুক্তি দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। ৭৮ বছর বয়সী এই দুইবারের প্রধানমন্ত্রীকে ২০১৮ সালে দুর্নীতির অভিযোগে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
জামাত-ই-ইসলামী ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচন থেকে বিএনপির প্রধান মিত্র হিসেবে কাজ করে আসছে। তবে শেখ হাসিনার শাসনামলে জামাতের শীর্ষ ছয় নেতাকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ফাঁসি দেওয়া হয়।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানিয়েছেন যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে এবং সাপ্তাহিক প্রতিবাদের সময় হতাহতদের ঘটনার তদন্ত করা হবে। ছাত্র প্রতিবাদের আয়োজকরা বলেছেন যে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার গঠন করা উচিত।
সাম্প্রতিক প্রতিবাদে প্রায় ৪০০ জন নিহত হয়েছে। শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করার পর সহিংসতায় আরও অনেকে নিহত হয়েছে।
বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন: মানবাধিকার লঙ্ঘনের জবাবদিহি চাইলেন জাতিসংঘ
জামাত-ই-ইসলামীর বর্তমান নেতৃত্ব এবং দলের ছাত্র শাখা ছাত্রশিবিরকে হাসিনা বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা এবং ভারত বিরোধী মনোভাব সৃষ্টির অভিযোগ করা হয়েছে। এর প্রমাণ হিসেবে ঢাকায় জনপ্রিয় ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করা হয়েছে। ছাত্রশিবির সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য সহিংস পন্থা অবলম্বন করে বলে পরিচিত।
সোমবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির সাথে সর্বদলীয় বৈঠকে জামাত নেতৃত্ব উপস্থিত ছিলেন, যেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা হয়। জামাত বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চায়, কিন্তু এটি দেশে রক্ষণশীল ও চরমপন্থী মতবাদকে উৎসাহিত করতে পারে। ডাক্তার শফিকুর রহমান বর্তমানে জামাতের আমির।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা জামাতকে নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং জামাতকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর আগে তিনি জামাতকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করেছিলেন এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের জন্য মতিউর রহমান নিজামীসহ জামাতের বরিষ্ঠ নেতাদের ফাঁসি দিয়েছিলেন।
জামাত নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপির সাথে জোট করেছে এবং প্রায়শই ছাত্রশিবিরের মাধ্যমে রাস্তার লড়াইয়ে শক্তি জুগিয়েছে। জামাতকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কারণ এর সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা করে জাতীয় সংবিধান লঙ্ঘন করেছিল। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, জামাতকে সভা-সমাবেশ করার মতো রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
জামাত-ই-ইসলামীর পূর্বসূরি, জামাত-ই-ইসলামী পাকিস্তান, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগিতা করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল এবং স্বাধীনতা
দ্ধের বিরোধিতা করেছিল। এই কারণে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে জামাতের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে জামাত-ই-ইসলামী বাংলাদেশ নামে নতুন দল গঠন করা হয়।
জামাত-ই-ইসলামীর বর্তমান অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ:
জামাত-ই-ইসলামীর পুনরায় রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এই পদক্ষেপ দেশের রাজনৈতিক পরিদৃশ্যে বিভিন্ন প্রভাব ফেলতে পারে:
১. রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা:
জামাতের পুনঃপ্রবেশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে আরও তীব্র করতে পারে। বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ক্ষেত্রে তারা একটি শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
২. ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্ন:
জামাতের ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সাথে সংঘাতপূর্ণ। এটি দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে।
৩. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক:
জামাতের পুনরায় সক্রিয়তা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে ভারতের সাথে সম্পর্কে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, কারণ জামাত ঐতিহাসিকভাবে ভারত বিরোধী অবস্থান নিয়ে এসেছে।
৪. সামাজিক সংহতি:
জামাতের ইসলামী মতাদর্শ বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে। এটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার নিয়ে উদ্বেগ বাড়াতে পারে।
৫. অর্থনৈতিক নীতি:
জামাতের ইসলামী অর্থনীতির ধারণা বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক মডেলের সাথে সংঘাতে আসতে পারে। এটি দেশের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।
৬. শিক্ষা ব্যবস্থা:
জামাতের ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি ঝোঁক দেশের শিক্ষা নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে। এটি ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে।
৭. নারী অধিকার:
জামাতের রক্ষণশীল ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি নারী অধিকার ও সমতার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। এটি বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের সাথে সংঘাতে যেতে পারে।
৮. গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া:
জামাতের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। এটি নির্বাচন প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের ধরণে পরিবর্তন আনতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত:
বাংলাদেশের রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ড. আলী রিয়াজ বলেন, “জামাত-ই-ইসলামীর পুনঃপ্রবেশ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে। এটি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।”
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. নাসরিন সুলতানা মনে করেন, “জামাতের পুনরায় সক্রিয়তা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে ভারত ও পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সম্পর্কে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।”
অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “জামাতের ইসলামী অর্থনীতির ধারণা বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক মডেলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। এটি দেশের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।”
নারী অধিকার কর্মী শাহীন আনাম মনে করেন, “জামাতের রক্ষণশীল ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি নারী অধিকার ও সমতার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এটি বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের অগ্রগতিকে ব্যাহত করতে পারে।”
জামাত-ই-ইসলামীর পুনরায় রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। এটি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য একটি বড় পরীক্ষা হতে পারে। জামাতের ভবিষ্যৎ ভূমিকা কী হবে তা নির্ভর করবে তাদের রাজনৈতিক কৌশল, জনগণের প্রতিক্রিয়া এবং সরকারের নীতির উপর।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামাত-ই-ইসলামীর পুনঃপ্রবেশ একটি জটিল ও বহুমাত্রিক বিষয়। এটি দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, ধর্মনিরপেক্ষতা, সামাজিক সংহতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিদৃশ্য কীভাবে বিকশিত হয় তা লক্ষ্য করার বিষয় হবে।