Janmashtami Vrat Rules: ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পবিত্র জন্মদিন জন্মাষ্টমী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক অত্যন্ত পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এই শুভ দিনে জন্মাষ্টমী ব্রত পালনের নিয়ম সঠিকভাবে অনুসরণ করলে ভক্তগণ আধ্যাত্মিক শান্তি, মানসিক প্রশান্তি এবং জীবনে সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল লাভ করতে পারেন। শাস্ত্রে উল্লেখ আছে, যদি কেউ একবারও শ্রীকৃষ্ণের এই জন্মাষ্টমী উপবাস সঠিকভাবে পালন করেন, তাহলে তাকে আর এই জড় জগতে জন্ম, মৃত্যু, ব্যাধি বা কষ্ট ভোগ করতে হয় না।
সৌর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে রোহিণী নক্ষত্রের প্রাধান্যের সময় জন্মাষ্টমী পালিত হয়। প্রতি বছর ইংরেজি ক্যালেন্ডারে অগস্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই পবিত্র তিথি পড়ে।
জন্মাষ্টমী ব্রতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী বাংলার হিন্দুসমাজের আচরণীয় ব্রতগুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্রত। হিন্দু, প্রধানত বৈষ্ণব মতাবলম্বীরা জাগতিক মঙ্গলকামনায় এবং অশুভ-অকল্যাণ দূর করতে এই পবিত্র ব্রত পালন করে থাকেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিষ্ণুর অষ্টম অবতার হিসেবে পরিচিত। তিনি ভাদ্রপদ মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে মধ্যরাতে মথুরায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই কারণেই এই দিনটি জন্মাষ্টমী নামে পরিচিত।
এই ব্রত পালনের মাধ্যমে ভক্তগণ শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক উন্নতি নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি ও শান্তি লাভ করে থাকেন।
জন্মাষ্টমী ব্রত পালনের নিয়ম – প্রস্তুতি পর্ব
জন্মাষ্টমীর ব্রত সফলভাবে সম্পন্ন করতে হলে যথাযথ প্রস্তুতি অত্যন্ত জরুরি। এই ব্রত সব হিন্দুরাই করতে পারবেন তবে নিয়ম-নীতি সঠিকভাবে অনুসরণ করতে হবে।
ব্রতের পূর্ববর্তী দিনের নিয়ম
জন্মাষ্টমীর আগের দিন থেকেই ব্রতীকে সংযম পালন করতে হবে। এই দিন নিরামিষ আহার গ্রহণ করে রাত ১২টার মধ্যে খাবার গ্রহণ সম্পন্ন করতে হবে। রাত্রে ঘুমানোর আগে ভালোভাবে দাঁত পরিষ্কার করে নিতে হবে যাতে দাঁতে খাবারের কোনো কণা আটকে না থাকে।
প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ
জন্মাষ্টমী ব্রত পালনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসেবে রাখতে হবে – ফুল, আতপ চাল, ফলের নৈবেদ্য, তুলসীপাতা, দূর্বা, ধূপ, দীপ, পঞ্চগব্য, পঞ্চগুড়ি, পাট, বালি, পঞ্চবর্ণের গুঁড়ো, মধু, পর্কের বাটি এবং আসন-অঙ্গুরী।
বিশেষ করে তাল ফল এই পূজায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তালের বড়া ও তালের কাঁচা রস নিবেদন করা আবশ্যক। এগুলো না থাকলে অন্তত গোটা তাল ফল নিবেদন করতে হবে।
উপবাস ও পূজার বিস্তারিত নিয়ম
উপবাসের নিয়মাবলী
জন্মাষ্টমীর দিন সকাল থেকে মধ্য রাত্রি পর্যন্ত সম্পূর্ণ উপবাস এবং জাগরণ পালন করতে হবে। এই সময়ে হরিনাম জপ, কৃষ্ণ লীলা শ্রবণ, ভগবানকে দর্শন, ভক্তদের সাথে হরিনাম কীর্তন এবং অভিষেক দর্শন করতে হবে।
উপবাসের সময় যা খাওয়া যাবে:
- জল, ঔষধ, চিনি মিশ্রিত শরবত এবং দুধ ছাড়া লাল চা
- যারা সম্পূর্ণ উপবাসে অক্ষম তারা ফলের রস ও কাঁচা দুধ খেতে পারবেন
- অসমর্থ ব্যক্তিরা কিছু ফলমূল খেয়ে থাকতে পারেন
তবে যাদের উপবাস পালনে সমস্যা বা যারা অসুস্থ, তারা দুপুর ১২টার পরে কৃষ্ণের কাছে ক্ষমা চেয়ে একটু দুধ বা ফল খেতে পারবেন। এই ব্রতে একাদশীর মতোই অন্ন-সহ পঞ্চ রবি শস্য খাওয়ার বিধান নেই।
পূজার পদ্ধতি
জন্মাষ্টমী পূজা রাত ৮টার পর শুরু করা উচিত, উপযুক্ত সময় হল রাত ১২টায়। পূজার জন্য একটি শান্ত ও কোলাহলমুক্ত স্থান নির্বাচন করতে হবে। স্থানটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং পূজার আগে স্নান সেরে নিতে হবে।
পূজার ক্রম:
- প্রথমে গণেশ, শ্রীগুরু, শিব, সূর্য, নারায়ণ, দুর্গা, নবগ্রহ এবং দশমহাবিদ্যার পূজা করতে হবে
- তারপর শ্রীকৃষ্ণ ও রাধারানীর পূজা করতে হবে
- ১০৮ তুলসী পত্রের মালা রাধামাধবকে দিতে হবে
- শ্রীকৃষ্ণের বীজ মন্ত্র ১০৮ বার জপ করতে হবে
ভোগ নিবেদনের নিয়ম:
ভগবানের পূজায় নারকেল নাড়ু, দই, ঘি, মধু, কাঁচা দুধ, ফলমূল, মাখন অথবা খোয়া ক্ষীর নিবেদন করা যায়। মিষ্টি, ফল ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী থালায় সাজিয়ে রাখতে হবে।
জন্মাষ্টমী ব্রত পালনের নিয়ম – পারণের বিধি
জন্মাষ্টমীর পরের দিন সকালে স্নান সেরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পারণ মন্ত্র পাঠ করে শ্রীকৃষ্ণের প্রসাদ দিয়ে পারণ করতে হবে।
পারণ আরম্ভের মন্ত্র:
“সর্বায় সর্বেশ্বরায় সর্বপতয়ে সর্বসম্ভবায় গোবিন্দায় নমো নমঃ।”
পারণান্তে মন্ত্র:
“ভূতায় ভূতেশ্বরায় ভূতপতয়ে ভূতসম্ভবায় গোবিন্দায় নমো নমঃ।”
পূজার পর প্রসাদ পরদিন গ্রহণ করার নিয়ম রয়েছে। তবে অসমর্থ ব্যক্তিরা পূজার পরেই প্রসাদ নিতে পারেন। যদি সম্ভব হয় তাহলে গোটা অষ্টমী তিথি উপবাস রাখা উচিত। তালের বড়া, সন্দেশে যেহেতু আটা-ময়দা থাকে, তাই এই প্রসাদ সেদিন না নিয়ে পরদিন নেওয়া উচিত।
জন্মাষ্টমী ব্রত পালনের উপকারিতা ও ফলাফল
এই পবিত্র ব্রত পালন করলে শতজন্মের মহাপাতক থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। শাস্ত্রমতে, যে ব্যক্তি এই ব্রত যথাযথভাবে পালন করেন, তিনি ইহজন্মেই অতুল ঐশ্বর্য প্রাপ্ত হন।
আধ্যাত্মিক উপকারিতা:
- মানসিক প্রশান্তি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ
- পাপমুক্তি ও পুণ্য অর্জন
- ভগবানের কৃপা ও আশীর্বাদ প্রাপ্তি
- জীবনে সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল
জাগতিক উপকারিতা:
- অশুভ-অকল্যাণ দূরীকরণ
- জীবনে সমৃদ্ধি ও শান্তি
- পারিবারিক সুখ-শান্তি
- স্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু লাভ
মথুরায় গমন করে শ্রীকৃষ্ণের বদনকমল অবলোকন করলে মানুষ যে ফল প্রাপ্ত হয়, কৃষ্ণজন্মাষ্টমী ব্রতের গুণে সেই ফলই লাভ হয়ে থাকে। দ্বারকায় বিশ্বেশ্বর হরিকে দর্শন করলে দীনজনগণ যে ফল প্রাপ্ত হয়, কৃষ্ণজন্মাষ্টমী ব্রতের অনুষ্ঠানেও সেই ফল লাভ হয়।
জন্মাষ্টমী ব্রত পালনের নিয়ম অনুসরণ করে এই পবিত্র উৎসব উদযাপনের মাধ্যমে আমরা শুধু আধ্যাত্মিক উন্নতি নয়, বরং জীবনের সকল ক্ষেত্রে দিব্য আশীর্বাদ লাভ করতে পারি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই মহিমান্বিত জন্মতিথিতে সকল ভক্তগণ যথাযথ নিয়মে ব্রত পালন করে তাঁর কৃপা ও আশীর্বাদ প্রাপ্ত হোন – এই কামনা করি।