Japan moon mission failure: জাপানের বেসরকারি মহাকাশ সংস্থা আইস্পেস পরিচালিত ‘রেজিলিয়েন্স’ চন্দ্রযান চাঁদে অবতরণের চূড়ান্ত মুহূর্তে ভেঙে পড়েছে। বৃহস্পতিবার (৫ জুন, ২০২৫) টোকিওর মিশন কন্ট্রোল থেকে চাঁদের ‘মারে ফ্রিগোরিস’ অঞ্চলে অবতরণের চেষ্টা চলাকালীন যানের সঙ্গে হঠাৎ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা ব্যর্থ হলে সংস্থাটি আনুষ্ঠানিকভাবে মিশন ব্যর্থ ঘোষণা করে।
এবারের ‘রেজিলিয়েন্স’ মিশন ছিল আইস্পেসের দ্বিতীয় চন্দ্রাভিযান। এর আগে ২০২৩ সালে তাদের প্রথম ‘হাকুতো-আর’ মিশনও অবতরণের শেষ মুহূর্তে দুর্ঘটনায় পড়ে। নতুন মিশনটি ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে স্পেসএক্স ফ্যালকন ৯ রকেটে চড়ে উৎক্ষেপণ করা হয়। দীর্ঘ চার মাসেরও বেশি সময় ধরে জটিল ও জ্বালানি-সাশ্রয়ী কক্ষপথে ঘুরে মে মাসে চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে যানটি।
‘রেজিলিয়েন্স’ চন্দ্রযান চাঁদের উত্তর গোলার্ধের ‘মারে ফ্রিগোরিস’ বা ‘সী অব কোল্ড’ অঞ্চলে অবতরণের পরিকল্পনা ছিল। এই অঞ্চলটি তুলনামূলকভাবে মসৃণ এবং সূর্যালোকপ্রাপ্ত, যা বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য উপযোগী বলে মনে করা হয়। যানটি ছিল প্রায় ২.৩ মিটার উচ্চতার, যার সঙ্গে যুক্ত ছিল ইউরোপীয় নির্মিত ছোট রোভার ‘টেনেসিয়াস’—যা সফল হলে ইউরোপের প্রথম চাঁদে চলমান রোভার হিসেবে ইতিহাস গড়ত। এছাড়া আরও কয়েকটি বৈজ্ঞানিক ও শিল্পকর্মের পে-লোড বহন করছিল যানটি।
অভিযানের দিন, যানটি ১০০ কিলোমিটার উচ্চতা থেকে অবতরণের জন্য ধাপে ধাপে গতি কমাতে শুরু করে। ২০ কিলোমিটার উচ্চতায় পৌঁছে মূল ইঞ্জিন চালু হয় এবং যানটি প্রায় উল্লম্ব ভঙ্গিতে নামতে থাকে। ঠিক এ সময়েই মিশন কন্ট্রোল টিম যানটির সঙ্গে টেলিমেট্রি ও যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। শেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, যানটি চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১৯২ মিটার ওপরে ছিল এবং প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত গতিতে নামছিল।
আইস্পেস জানিয়েছে, অবতরণের সময় যানটির লেজার রেঞ্জফাইন্ডার (দূরত্ব নির্ণায়ক সেন্সর) সঠিকভাবে চাঁদের পৃষ্ঠের দূরত্ব নির্ণয় করতে বিলম্ব করছিল। ফলে যানটি যথাযথভাবে গতি কমাতে পারেনি এবং ‘হার্ড ল্যান্ডিং’ বা প্রচণ্ড ধাক্কায় চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়ে। এই সেন্সরজনিত ত্রুটির কারণেই সফট ল্যান্ডিং সম্ভব হয়নি বলে প্রাথমিক বিশ্লেষণে জানা গেছে।
মিশন কন্ট্রোল থেকে যানটির কম্পিউটার রিবুট করার চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে চূড়ান্তভাবে মিশন ব্যর্থ ঘোষণা করা হয়। আইস্পেসের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও তাকেশি হাকামাদা দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। আমরা দ্রুত টেলিমেট্রি ডেটা বিশ্লেষণ করে ব্যর্থতার কারণ খুঁজে বের করব এবং ভবিষ্যতে আরও উন্নত মিশনের জন্য প্রস্তুতি নেব”।
এই ব্যর্থতা শুধু আইস্পেসের জন্য নয়, বরং বেসরকারি মহাকাশ উদ্যোগের জন্যও বড় ধাক্কা। কারণ, চাঁদে সফলভাবে অবতরণ এখনো পর্যন্ত মাত্র পাঁচটি দেশের পক্ষে সম্ভব হয়েছে—রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও জাপান (সরকারি সংস্থার মাধ্যমে)। বেসরকারি সংস্থার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ফায়ারফ্লাই অ্যারোস্পেস ও ইন্টুইটিভ মেশিনস চন্দ্রাভিযানে আংশিক সফলতা দেখিয়েছে। আইস্পেস সফল হলে এটি হতো ইতিহাসে তৃতীয় সফল বেসরকারি চন্দ্রাভিযান এবং প্রথম জাপানি বেসরকারি সংস্থা হিসেবে চাঁদে অবতরণের কৃতিত্ব।
‘রেজিলিয়েন্স’ মিশনের মূল বৈজ্ঞানিক ও বাণিজ্যিক লক্ষ্য ছিল চাঁদের মাটিতে রোভার নামিয়ে নমুনা সংগ্রহ, পানির উপস্থিতি পরীক্ষা, খাদ্য উৎপাদন সংক্রান্ত পরীক্ষা এবং মহাকাশ বিকিরণ পরিমাপ। এছাড়া, সুইডিশ শিল্পী মিকায়েল জেনবার্গের একটি ছোট্ট লাল বাড়ির শিল্পকর্মও চাঁদের মাটিতে স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল, যা চাঁদে শিল্প-উপস্থাপনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করত।
আইস্পেসের আগের মিশন ‘হাকুতো-আর’ ২০২৩ সালে চাঁদের পৃষ্ঠে অবতরণের সময় সফটওয়্যারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে দুর্ঘটনার শিকার হয়। সে সময়ও সেন্সর থেকে পাওয়া তথ্য ভুলভাবে ফিল্টার হয়ে গিয়েছিল, ফলে যানটি নিজের উচ্চতা ভুলভাবে নির্ধারণ করেছিল এবং জ্বালানি শেষ হয়ে পড়ে চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়ে। এবারের মিশনে সফটওয়্যারে উন্নতি আনা হলেও সেন্সরজনিত বিলম্বই মূলত দুর্ঘটনার কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে চন্দ্রাভিযান নিয়ে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। সরকারি সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণে চাঁদের বাণিজ্যিক ও বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা নতুন মাত্রা পাচ্ছে। তবে টেকনিক্যাল চ্যালেঞ্জ ও জটিলতা এখনো বড় বাধা হয়ে আছে। আইস্পেসের এই ব্যর্থতা ভবিষ্যতের মিশনের জন্য শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সবশেষে, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ও আইস্পেসের বিনিয়োগকারীরা সংস্থাটির পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে সফলতার প্রত্যাশা প্রকাশ করেছেন। আইস্পেস কর্তৃপক্ষও জানিয়েছে, তারা ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ করে আগামী দিনে আরও উন্নত প্রযুক্তি ও পরিকল্পনা নিয়ে চন্দ্রাভিযান চালিয়ে যাবে।