Jhulan Yatra 2025: বর্ষার মেঘলা আকাশে যখন প্রেমের সুর বেজে ওঠে, তখনই শুরু হয় হিন্দু ধর্মের অন্যতম মধুর উৎসব ঝুলনযাত্রা। রাধাকৃষ্ণের অমর প্রেমকাহিনীকে কেন্দ্র করে এই বিশেষ পার্বণ প্রতি বছর কোটি মানুষের হৃদয়ে আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসে। কিন্তু আপনি কি জানেন ২০২৫ সালে ঝুলনযাত্রা কবে শুরু হবে আর কোন দিন শেষ হবে? আজকের এই বিস্তারিত আলোচনায় আমরা জানব ঝুলনযাত্রার সম্পূর্ণ তারিখ, এর গভীর ইতিহাস এবং পালনের বিশেষ নিয়মকানুন।
২০২৫ সালে ঝুলনযাত্রার শুরু ও শেষ তারিখ
অনেকেই প্রশ্ন করেন, “২০২৫ সালে ঝুলনযাত্রা কবে?” পঞ্জিকা অনুযায়ী, এবছর ঝুলনযাত্রা ৫ আগস্ট, ২০২৫ (মঙ্গলবার) থেকে শুরু হয়ে ৯ আগস্ট, ২০২৫ (শনিবার) পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে। তবে অন্য একটি সূত্র মতে, ঝুলনযাত্রা ১৪ আগস্ট, ২০২৫ (বৃহস্পতিবার) থেকে শুরু হয়ে ১৬ আগস্ট, ২০২৫ (শনিবার) পর্যন্ত চলবে।
কেন এই তারিখের পার্থক্য?
ঝুলনযাত্রা মূলত শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথি থেকে শুরু হয়ে পূর্ণিমা তিথি পর্যন্ত পালিত হয়। তিথির হিসাবে স্থানভেদে সামান্য পার্থক্য হতে পারে, তাই বিভিন্ন অঞ্চলে এই উৎসব কিছুটা ভিন্ন সময়ে পালিত হয়ে থাকে।
ঝুলনযাত্রার গভীর ইতিহাস ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য
দ্বাপর যুগের অমর প্রেমকাহিনী
ঝুলনযাত্রার শুরু হয়েছিল দ্বাপর যুগে। বৃন্দাবনের কুঞ্জবনে যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সখা-সখীদের সঙ্গে লীলায় মগ্ন ছিলেন, তখন শ্রাবণের বর্ষায় তাঁরা একত্রে দোল খেয়ে আনন্দ করতেন। শ্রাবণের ভেজা হাওয়া, গাছের ছায়া এবং মৃদু বৃষ্টির ছোঁয়ায় রাধা ও শ্রীকৃষ্ণ দোলনায় দোলার মাধ্যমে প্রকাশ করতেন তাঁদের অসীম প্রেম।
“ঝুলনযাত্রা বা লীলা বর্ষার লীলা” – এই বাক্যটি সুন্দরভাবে তুলে ধরে এই উৎসবের মূল চেতনা। বৃন্দাবনে রাধা-কৃষ্ণের শৈশব-স্মৃতি, বিশেষ করে সখা-সখীদের সাথে দোলনায় দোলার প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করেই এই পবিত্র অনুষ্ঠানের সূত্রপাত হয়েছিল।
অষ্টসখীর সাথে ঐশ্বরিক লীলা
পুরাণ অনুযায়ী, শ্রীকৃষ্ণ রাধার অষ্টসখীর সঙ্গে একত্রে বৃন্দাবন কুঞ্জে নৃত্য-গীত সহযোগে রাধার সাথে দোলনায় ঝুলেছিলেন। এই অষ্টসখীর নাম হলো – ইন্দুরেখা, চিত্রা, চম্পকলতা, ললিতা, বিশাখা, তুঙ্গবিদ্যা, সুদেবী এবং রঙ্গদেবী।
ঝুলনযাত্রা কীভাবে পালিত হয়?
দোলনা সাজানো থেকে শুরু
ঝুলনযাত্রার মূল আকর্ষণ হলো দোলনা সাজানো। এই উৎসবের সময় সুন্দরভাবে সজ্জিত দোলনা তৈরি করা হয়, যা প্রায়শই সোনা বা রূপার তৈরি হয়ে থাকে। দোলনার উপর ভগবান কৃষ্ণ ও দেবী রাধার মূর্তি স্থাপন করা হয়।
পাঁচদিনের মহোৎসব
সাধারণত পাঁচদিন ধরে ঝুলনযাত্রা পালিত হয়, তবে কোথাও কোথাও তিনদিন ব্যাপীও এই অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এই সময়ে চলে:
- দিনভর কীর্তন ও সংকীর্তন
- ভক্তিমূলক ভজন ও আরতি
- রাধাকৃষ্ণের বিশেষ পূজা
- প্রসাদ বিতরণ
- সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নৃত্য-গীত
বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান
ভক্তরা সঙ্গীত এবং নৃত্যের সাথে দোলনাটি এদিক ওদিক ঘোরান। এসময় ভগবান কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে নিবেদিত ভক্তিমূলক স্তোত্র এবং গান গাওয়া হয়। দেবতার উদ্দেশ্যে বিশেষ খাদ্য নৈবেদ্য প্রদান করা হয় এবং বিশেষ আরতি সম্পন্ন হয়।
ঝুলনযাত্রার প্রসিদ্ধ স্থানসমূহ
বৃন্দাবন ও মথুরা – মূল কেন্দ্র
বৃন্দাবন ঝুলনযাত্রার মূল কেন্দ্রবিন্দু। কৃষ্ণের লীলাভূমি হওয়ায় এখানে সবচেয়ে বড় আকারে এই উৎসব পালিত হয়। মথুরা এবং বৃন্দাবন শহর দুটি ভারতের সমস্ত স্থানের মধ্যে ঝুলনযাত্রা উদযাপনের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত।
পশ্চিমবঙ্গের গর্ব
পশ্চিমবঙ্গে মায়াপুর হলো ঝুলনযাত্রার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। ইসকনের বিশ্ব সদর দপ্তর এখানে অবস্থিত হওয়ায় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ভক্তরা এখানে আসেন। এছাড়াও:
- নবদ্বীপ – শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান
- শান্তিপুর – ঐতিহ্যবাহী ঝুলন উৎসব
- বউবাজারের রামকানাই অধিকারীর ঝুলনবাড়ি
- মেদিনীপুরের মহিষাদল রাজবাড়ি – ২০০ বছরের ঐতিহ্য
বিশ্বের ৭টি সর্বাধিক পবিত্র গাছ: যেখানে আধ্যাত্মিকতা ও প্রকৃতির মিলন ঘটেছে
অন্যান্য বিখ্যাত স্থান
সারা ভারতজুড়ে আরও অনেক স্থানে মহা ধুমধাম করে ঝুলনযাত্রা পালিত হয়:
- পুরীর জগন্নাথ মন্দির
- আমেদাবাদের কৃষ্ণ মন্দির
- ভুবনেশ্বরের কাঠিয়াবাবার আশ্রম
- বৃন্দাবনের বাঁকেবিহারী মন্দির
ঝুলনযাত্রার আধুনিক তাৎপর্য
প্রকৃতির সঙ্গে মিলনের বার্তা
আজকের যুগেও ঝুলনযাত্রা আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয় – প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকার। এই উৎসব আমাদের শেখায় যে ঋতুকে উপভোগ করতে হবে এবং দোলনার দোলায় শ্রাবণের পরশ অনুভব করতে হবে।
প্রেম ও ভক্তির প্রতীক
দোলনা হলো ভগবান কৃষ্ণ এবং রাধার আনন্দ ও প্রেমময় মুহূর্তগুলির প্রতীক। এটি বর্ষাকালে আনন্দ, ভালোবাসা এবং ভক্তি প্রকাশ করে।
সামাজিক ঐক্যের প্রতীক
হোলি এবং জন্মাষ্টমীর পরে, ঝুলনযাত্রা বৈষ্ণবদের সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এই উৎসব সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একত্রিত করে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেয়।
ঝুলনযাত্রা কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি আমাদের জীবনে প্রেম, আনন্দ এবং প্রকৃতির সাথে মিলনের এক অপূর্ব বার্তা নিয়ে আসে। ২০২৫ সালের এই পবিত্র উৎসবে আমরা সবাই রাধাকৃষ্ণের অসীম প্রেমের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে একটি সুন্দর ও সুখময় জীবন গড়তে পারি। আগামী আগস্ট মাসে যখন শ্রাবণের মেঘমালা আকাশ ছেয়ে ফেলবে, তখন আপনিও অংশ নিন এই মধুর ঝুলনযাত্রার মহোৎসবে।আপনার মন্তব্য ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন। এই পোস্টটি পছন্দ হলে আপনার বন্ধুবান্ধবদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না!