রিলায়েন্স জিও ভারতের টেলিকম ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক স্থাপন করেছে। কোম্পানিটি তাদের ৯ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রাক্কালে ৫০ কোটি গ্রাহক সংখ্যা অতিক্রম করার ঘোষণা দিয়েছে। এই ঐতিহাসিক অর্জনকে স্মরণীয় করে রাখতে জিও তাদের গ্রাহকদের জন্য বিশেষ ডেটা অফার ও সেলিব্রেশন প্ল্যানের ব্যবস্থা করেছে, যা আগামী ৫ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হবে।
জিওর চেয়ারম্যান আকাশ আম্বানি এই মাইলফলক উপলক্ষে বলেছেন, “জিওর ৯ম বার্ষিকীতে আমি সত্যিই বিনীত বোধ করছি যে ৫০ কোটিরও বেশি ভারতীয় আমাদের উপর আস্থা রেখেছেন। একটি দেশের মধ্যে এই পরিমাণ পৌঁছানো প্রতিফলিত করে যে জিও কতটা গভীরভাবে দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে”। তিনি আরও যোগ করেন, “এটি সংযোগের অবিশ্বাস্য শক্তি দেখায় একটি প্রাণবন্ত ডিজিটাল সমাজ গঠনে”।
জিওর এই অর্জন বিশ্বব্যাপী টেলিকম জগতে একটি নতুন রেকর্ড। কোম্পানির গ্রাহক সংখ্যা এখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। এর মাধ্যমে জিও বিশ্বের সবচেয়ে বড় মোবাইল ডেটা নেটওয়ার্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
জিওর বার্ষিকী উদযাপনের অংশ হিসেবে ৫ থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সকল ৫জি স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা তাদের বর্তমান প্ল্যান নির্বিশেষে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আনলিমিটেড ৫জি ডেটা উপভোগ করতে পারবেন। অন্যদিকে ৪জি ব্যবহারকারীরা মাত্র ৩৯ টাকা অ্যাড-অন প্যাকের মাধ্যমে আনলিমিটেড ৪জি ডেটা পাবেন, যদিও এটি প্রতিদিন ৩ জিবি হাই-স্পিড ডেটার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
বিশেষ সেলিব্রেশন প্ল্যানের আওতায় জিও ৩৪৯ টাকার একটি বার্ষিকী প্ল্যান চালু করেছে, যা ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। এই প্ল্যানে রয়েছে আনলিমিটেড ৫জি ডেটা, প্রতিদিন ২ জিবি ৪জি ডেটা এবং আনলিমিটেড কলিং সুবিধা। এছাড়াও গ্রাহকরা পাবেন জিও ফিন্যান্সের মাধ্যমে ২ শতাংশ অতিরিক্ত ডিজিটাল সোনা এবং ৩,০০০ টাকা মূল্যের সেলিব্রেশন ভাউচার।
এই ভাউচারের মধ্যে রয়েছে জিওহটস্টার, জিওসাভন প্রো, জোমাটো গোল্ড, নেটমেডস ফার্স্ট, রিলায়েন্স ডিজিটাল ক্যাশব্যাক, এজিও ফ্যাশন ডিল এবং ইজমাইট্রিপ ট্রাভেল বেনিফিটের মতো প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশন ও অফার। প্রিপেইড এবং পোস্টপেইড উভয় ধরনের গ্রাহকরাই এই সুবিধা পাবেন।
দীর্ঘমেয়াদী গ্রাহকদের জন্য জিও বিশেষ পুরস্কারের ব্যবস্থা রেখেছে। যারা পরপর ১২ মাস ৩৪৯ টাকার রিচার্জ করবেন, তারা ১৩তম মাসের সেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পাবেন। এটি জিওর গ্রাহক আনুগত্য কর্মসূচির অংশ।
জিওহোম সেবার নতুন গ্রাহকদের জন্যও রয়েছে বিশেষ অফার। ১,২০০ টাকার সেলিব্রেশন প্ল্যানে পাওয়া যাবে দুই মাসের জিওহোম সংযোগ, যাতে রয়েছে ১,০০০+ টিভি চ্যানেল, ৩০ এমবিপিএস আনলিমিটেড ডেটা, ওয়াই-ফাই ৬ রাউটার এবং ৪কে স্মার্ট সেট টপ বক্স। এর সাথে পাওয়া যাবে ১২+ ওটিটি অ্যাপের সাবস্ক্রিপশন এবং দুই মাসের অ্যামাজন প্রাইম লাইট সাবস্ক্রিপশন।
২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু করার পর থেকে জিও ভারতের টেলিকম শিল্পে এক বিপ্লব এনেছে। কোম্পানিটি শুরুতেই বিনামূল্যে ভয়েস কল এবং অত্যন্ত সাশ্রয়ী ডেটা সেবার মাধ্যমে বাজারে ঝড় তুলেছিল। জিওর “ওয়েলকাম অফার” এর আওতায় গ্রাহকরা প্রথম কয়েক মাস সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ডেটা ও কলিং সুবিধা পেয়েছিলেন।
মাত্র ১৭০ দিনে ১০ কোটি গ্রাহক অর্জনের মাধ্যমে জিও বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিল। এই অভূতপূর্ব সাফল্য প্রতিষ্ঠিত টেলিকম কোম্পানিগুলোকে তাদের কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করে। এয়ারটেল, ভোডাফোন এবং আইডিয়ার মতো কোম্পানিগুলো দাম কমাতে বাধ্য হয়েছিল।
জিওর প্রভাবে ভারতের টেলিকম বাজারে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ভোডাফোন ও আইডিয়া একীভূত হতে বাধ্য হয়েছে, অনেক ছোট অপারেটর বাজার ছেড়ে চলে গেছে। বর্তমানে জিও ভারতের টেলিকম বাজারে ৪০.৪৬ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে এক নম্বর অবস্থানে রয়েছে।
টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অব ইন্ডিয়া (ট্রাই) এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত জিওর গ্রাহক সংখ্যা ৪৭.৭৫ কোটি, যেখানে এয়ারটেলের ৩৯.১৫ কোটি এবং ভোডাফোন আইডিয়ার ২০.৩৯ কোটি গ্রাহক রয়েছে। জিও ও এয়ারটেল একসাথে ভারতের ৯২.২ শতাংশ বেসরকারি টেলিকম বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।
৫জি সেবার ক্ষেত্রেও জিও এগিয়ে রয়েছে। কোম্পানিটি ২০২২ সালের অক্টোবরে দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা ও চেন্নাইতে ৫জি সেবা চালু করে। ২০২৩ সালের আগস্টের মধ্যে জিও সারাদেশে ৫জি নেটওয়ার্ক বিস্তার সম্পন্ন করেছে। ৫জি ফিক্সড ওয়্যারলেস অ্যাক্সেস (এফডব্লিউএ) সেক্টরে জিওর রয়েছে ৮৫ শতাংশ মার্কেট শেয়ার।
জিওর এই সাফল্য কেবল টেলিকম খাতেই সীমাবদ্ধ নেই। কোম্পানিটি ভারতের ডিজিটাল বিপ্লবের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে। সাশ্রয়ী ইন্টারনেট সেবার মাধ্যমে লাখো মানুষের হাতে প্রথমবারের মতো স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট পৌঁছে দিয়েছে জিও।
ই-কমার্স, ডিজিটাল পেমেন্ট, অনলাইন শিক্ষা এবং টেলিমেডিসিনের মতো সেক্টরগুলোর বিকাশে জিওর অবদান অনস্বীকার্য। গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছে দিয়ে ডিজিটাল বিভাজন কমাতেও ভূমিকা রেখেছে কোম্পানিটি।
বর্তমানে জিও শুধু টেলিকম সেবা নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল ইকোসিস্টেম গড়ে তুলেছে। জিওসিনেমা, জিওটিভি, জিওসাভনের মতো বিনোদন প্ল্যাটফর্ম থেকে শুরু করে জিওমার্ট, জিওপে এবং জিওফাইবারের মতো সেবা দিয়ে গ্রাহকদের সকল ডিজিটাল চাহিদা পূরণ করছে।
আগামী দিনে জিও আরও উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ৬জি প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে কোম্পানির। জিওস্পেসফাইবার নামে স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড সেবা নিয়েও কাজ করছে তারা।
জিওর এই যাত্রা কেবল একটি টেলিকম কোম্পানির সাফল্যের গল্প নয়, বরং এটি ভারতের ডিজিটাল রূপান্তরের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ৫০ কোটি গ্রাহকের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে জিও প্রমাণ করেছে যে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সঠিক ব্যবহারে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান কতটা উন্নত করা সম্ভব।
প্রতিষ্ঠার মাত্র নয় বছরে বিশ্বের বৃহত্তম মোবাইল ডেটা নেটওয়ার্ক হয়ে ওঠা জিওর অর্জন ভবিষ্যতে ভারতীয় টেকনোলজি সেক্টরের জন্য একটি অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবে। আগামী দিনে ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে জিওর ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে প্রত্যাশা করা যায়।