ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনা দক্ষিণ এশিয়াকে এক নতুন সংকটের মুখে ফেলেছে। গত মে মাসে ঘটে যাওয়া পারমাণবিক শক্তিধর দুটি দেশের মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র বিনিময়ের ঘটনা পুরো উপমহাদেশকে আবার যুদ্ধের প্রান্তে নিয়ে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে যারা “যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই” এই সহজ বার্তা দিচ্ছেন, তাদেরকে অনেক ক্ষেত্রেই ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, শান্তির পক্ষে কথা বলা কি সত্যিই দেশদ্রোহিতা, নাকি তা বাস্তবতার সত্যিকার অনুধাবন?
যুদ্ধের ছায়া ও শান্তির আহ্বান
গত ২২ এপ্রিল, ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পাহেলগামে একটি ভয়াবহ হামলায় ২৬ জন নিহত হয়েছিল। এর জবাবে ভারত সরকার পাকিস্তানকে সেই হামলার জন্য দায়ী করে এবং ৬ মে মধ্যরাতে পাকিস্তানের ছয়টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এসব হামলায় অন্তত ৪১ জন নিহত হয় এবং অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হন। পরবর্তীতে পাকিস্তানও পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়36।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দুই দেশ ‘সম্পূর্ণ ও তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে’ পৌঁছায়, যদিও উভয় দেশ থেকেই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। এই সমস্ত ঘটনা প্রবাহ দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতাকে গভীরভাবে আন্দোলিত করেছে3।
শান্তির অনুরাগী = দেশদ্রোহী? একটি ভুল সমীকরণ
আমাদের সমাজে একটি ভুল ধারণা ক্রমশ শিকড় গাড়ছে যে শান্তির পক্ষে কথা বলা মানেই দেশদ্রোহী হওয়া। এই ধারণা কতটা অসত্য তা বোঝার জন্য গভীরে যেতে হবে। মহাপুরুষদের বাণী ও মহান ভারতীয় ঐতিহ্য সর্বদা শান্তি ও অহিংসার পথকেই শ্রেষ্ঠ বলে চিহ্নিত করেছে।
গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন, “যুদ্ধ বা হিংসা কোনো সমস্যার সমাধান নয়। যুদ্ধের দ্বারা আরো যুদ্ধ বৃদ্ধি লাভ করবে। হিংসার দ্বারা হিংসা বৃদ্ধি লাভ করে। তাই অহিংসার মাধ্যমে, সাধুতার মাধ্যমে এবং সততা ও সত্যের মাধ্যমে আমাদের ভারত যুগে যুগে জয় লাভ করেছে”1।
শান্তির জন্য বক্তব্য: দুর্বলতা নয়, সাহসিকতা
শান্তির পক্ষে কথা বলা কখনোই দুর্বলতার পরিচায়ক নয়। বরং, এটি এক অসাধারণ সাহসিকতার পরিচয়। বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং ইতিহাস থেকে স্পষ্ট যে যুদ্ধ কখনোই কোন সমস্যার স্থায়ী সমাধান আনে না। একটি যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ক্ষত বয়ে বেড়ায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
বাস্তবতাবোধের প্রকৃত অর্থ
যারা শান্তির পক্ষে কথা বলেন তাদেরকে “ফ্যান্টাসি ছেড়ে বাস্তবের মাটি চেনে না” এমন অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু বাস্তবতা কি শুধুই যুদ্ধ ও সংঘাত? বাস্তবতার অন্য দিকটিও দেখা জরুরি:
- অর্থনৈতিক প্রভাব: যুদ্ধে উভয় দেশের অর্থনীতির প্রচুর ক্ষতি হয়
- মানবিক দিক: হাজার হাজার সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু ও গৃহহারা হওয়া
- দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব: পিছিয়ে যাওয়া উন্নয়ন, মানসিক আঘাত ও সামাজিক ভাঙন
সত্যিকারের বাস্তবতাবোধ হল এই সমগ্র চিত্রটি বোঝা এবং যুদ্ধের চেয়ে শান্তির পথে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা।
ভারতের সনাতন ঐতিহ্য ও শান্তির বার্তা
ভারতের সনাতন ঐতিহ্যে সর্বদাই শান্তি, সহাবস্থান এবং অহিংসার বার্তা রয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন যে ভারত হল সেই ভূমি, যেখান হইতে ধর্ম ও দার্শনিক তত্ত্বসমূহ বন্যার মত প্রবাহিত হইয়া সমগ্র পৃথিবীকে প্লাবিত করিয়াছে2।
গৌতম বুদ্ধের শান্তি দর্শন
গৌতম বুদ্ধের দর্শন ভারতীয় চিন্তাধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিনি বলেছিলেন, “একবার বুঝাও, দুইবার বুঝাও, তিনবার বুঝাও” – অর্থাৎ সমস্যার সমাধানে সর্বপ্রথম আলোচনা ও কূটনৈতিক পথ অবলম্বন করা উচিত1। এই দর্শন বর্তমান সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
ভারতের ভবিষ্যৎ: শান্তি নাকি যুদ্ধ?
প্রশ্ন হল, ভারতের ভবিষ্যৎ কোন পথে অগ্রসর হবে? যুদ্ধ নাকি শান্তি? এই প্রশ্নের উত্তর জটিল, তবে ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি কিছু দিকনির্দেশনা দেয়।
স্থিতিশীলতার জন্য সমন্বিত কৌশল
ভারতের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের সামরিক শক্তি শক্তিশালী রাখা জরুরি, তবে সেই সাথে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং তথ্যগত সকল উপায়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যাকে বলা হয় ‘স্মার্ট শক্তি’ ব্যবহার4।
বৃহত্তর লক্ষ্য হওয়া উচিত ভারতকে এমন একটি নিষ্ক্রিয় রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া থেকে বিরত রাখা, যে রাষ্ট্র নিজের নিরাপত্তার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয় না4। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে আমরা সংঘাত ও যুদ্ধকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে দেখব।
আঞ্চলিক সহযোগিতা ও শান্তি
দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিতে যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হল শান্তি, উন্নয়ন ও আঞ্চলিক সহযোগিতা56। ঐক্যবদ্ধ মনোভাব ও সহযোগিতার মাধ্যমেই এ অঞ্চলের উন্নয়ন সম্ভব।
সহনশীলতা ও একতার শক্তি
পূর্ব থেকেই ঐক্য ও একতার শক্তি ভারতীয় দর্শনে প্রতিফলিত হয়েছে: “সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সং বো মনাংসি জানতাম্” – অর্থাৎ “তোমরা সকলে এক-অন্তঃকরণবিশিষ্ট হও”2।
এই বার্তাটি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সহযোগিতা, বোঝাপড়া ও সম্পর্কের উন্নয়নের মধ্য দিয়েই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব।
যুদ্ধের বাস্তবতা: কেউই প্রকৃত বিজয়ী নয়
অতীতের অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান পরিস্থিতি থেকে স্পষ্ট যে যুদ্ধে কেউই প্রকৃত অর্থে বিজয়ী হয় না। ১৯৬০ সালে সম্পাদিত সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিতের মতো চরম সিদ্ধান্ত যে পরিণতি আনতে পারে, তা পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীলতায় ফেলতে পারে6।
উন্নয়ন ও মানবিক উদ্যোগ
শান্তি ও সহযোগিতার পথেই দারিদ্র্য, অশিক্ষা, পরিবেশ সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি সমস্যা মোকাবেলা সম্ভব। এই সমস্যাগুলি যুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবিক ও তাৎপর্যপূর্ণ।
শান্তির বার্তা: শিখুন ভিক্ষুদের কাছ থেকে
সাম্প্রতিককালে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ভারত সরকারের কাছে “যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই” এই আবেদন জানিয়েছেন1। তাঁরা উল্লেখ করেছেন যে হিংসার দ্বারা হিংসা নয়, বরং অহিংসার মাধ্যমে, সাধুতার মাধ্যমে এবং সত্যের মাধ্যমেই ভারত যুগে যুগে জয় লাভ করেছে।
এই বার্তাটি আমাদের ভাবিয়ে তোলে: বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকৃত দেশপ্রেম কী? যারা যুদ্ধের পক্ষে, নাকি যারা শান্তির পক্ষে?
ভারতের ভবিষ্যৎ: শান্তির অন্বেষণে
স্বামী বিবেকানন্দের বাণী অনুযায়ী, “ভারতের ভবিষ্যৎ ঐক্যের উপর নির্ভর করিতেছে”2। আর্য-দ্রাবিড়, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ ইত্যাদি বিভাজনগুলির ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা প্রয়োজন।
একইভাবে, ভারত ও তার প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে শান্তি ও সহযোগিতার পথেই উপমহাদেশের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সাহসী নেতৃত্ব, কূটনৈতিক দক্ষতা ও দূরদর্শী চিন্তা।
শান্তির পক্ষে কণ্ঠস্বর – দেশপ্রেমেরই প্রকাশ
শান্তির পক্ষে কথা বলা কোনোভাবেই দেশদ্রোহিতা নয়, বরং এটি প্রকৃত দেশপ্রেমেরই প্রকাশ। বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় ও ঐতিহ্যবাহী দেশ সর্বদাই শান্তি, সহনশীলতা ও সম্প্রীতির পথেই সত্যিকারের সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে।
যুদ্ধের রক্তাক্ত পথ কখনোই সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়; বরং তা নতুন সমস্যা ও সংঘাতের সূত্রপাত করে। দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের প্রকৃত প্রয়োজন শান্তি, উন্নয়ন ও আঞ্চলিক সহযোগিতা5। প্রয়োজন কৌশলগত দূরদর্শিতা, স্থিরতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
তাই “যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই” এই কথাটি বলা দেশদ্রোহিতা নয়, বরং বাস্তবতার প্রকৃত উপলব্ধি। ভারতের ভবিষ্যৎ যেন শান্তির পথেই অগ্রসর হয়, কারণ মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে গৌতম বুদ্ধ পর্যন্ত সবাই একই বার্তা দিয়েছেন – শান্তি ছাড়া মুক্তি নেই, অহিংসা ছাড়া উন্নতি নেই।