জুলাই ঘোষণাপত্রে ২৮ দফায় ইতিহাস সৃষ্টি: শহীদদের জাতীয় বীর ঘোষণা, সংবিধানে স্থান পাবে গণঅভ্যুত্থান

Chanchal Sen 6 Min Read

July Declaration contains 28 Demands: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আজ মঙ্গলবার বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ২৮ দফার ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেছেন। এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে এবং অভ্যুত্থানের সকল শহীদদের ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ‘৩৬ জুলাই উদ্যাপন’ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের উপস্থিতিতে এই ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়।

ঘোষণাপত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এটি পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে সন্নিবেশিত থাকবে। ২৭ নম্বর দফায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “বাংলাদেশের জনগণ এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে যে ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪-এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে”।

লেবাননে পেজার বিস্ফোরণে মৃত্যু বাড়ছে, ইজরায়েলের বিরুদ্ধে হিজবুল্লাহর প্রতিশোধের হুমকি

জুলাই ঘোষণাপত্রটি শুধু একটি রাজনৈতিক দলিল নয়, বরং এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে ২০২ৄ সালের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত দেশের সামগ্রিক ইতিহাস তুলে ধরেছে। প্রথম দুটি দফায় উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বিবৃত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন পদ্ধতি, এর কাঠামোগত দুর্বলতা এবং অপপ্রয়োগের সমালোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে যে স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছিল এবং বাকশালের নামে সাংবিধানিকভাবে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার কথাও উল্লেখ রয়েছে।

ঘোষণাপত্রে গত ষোলো বছরের আওয়ামী লীগ শাসনামলের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। সপ্তম থেকে দশম দফায় শেখ হাসিনার সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসন, গুম-খুন, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংসের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। একই সাথে তথাকথিত উন্নয়নের নামে পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ুকে বিপন্ন করার অভিযোগও আনা হয়েছে।

ঘোষণাপত্রের ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ দফায় ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘটনাপ্রবাহ বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার বিলোপ ও দুর্নীতি প্রতিরোধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ব্যাপক দমন-পীড়ন, বর্বর অত্যাচার ও মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ড চালানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই দমন-পীড়নের ফলে সারা দেশে দল-মত নির্বিশেষে ছাত্র-জনতার উত্তাল গণবিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।

আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ: অন্তর্বর্তী সরকারের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হিসেবে ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী বাহিনী রাজপথে নারী-শিশুসহ প্রায় এক হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে এবং অগণিত মানুষ পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বরণ করেছে। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াইকে সমর্থন প্রদান করেছিল বলেও উল্লেখ রয়েছে।

চব্বিশ নম্বর দফায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সকল শহীদকে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে ঘোষণা করার পাশাপাশি শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা এবং আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে প্রয়োজনীয় সব আইনি সুরক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছে। এই ঘোষণা শহীদ পরিবারগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি এবং ভবিষ্যতে তাদের আইনি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করবে।

ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা প্রসঙ্গে ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের জনগণ যুক্তিসংগত সময়ে আয়োজিতব্য অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদে প্রতিশ্রুত প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে। একই সাথে পরিবেশ ও জলবায়ু সহিষ্ণু অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষণের প্রত্যাশাও ব্যক্ত করা হয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া মিশ্র হয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দ্রুত এর সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী নেতারা দলীয় ফোরামে বিশ্লেষণের পর প্রতিক্রিয়া দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে জামায়াতের নায়েবে আমির আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের মন্তব্য করেছেন যে এতে অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হয়নি।

অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা মনে করেন যে ঘোষণাপত্রে সরকার সবাইকে এক করতে পেরেছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জুলাই ঘোষণাপত্র ও প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং বলেছেন যে তারা জুলাই ঘোষণাপত্রের যেসব ঘোষণা তা রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এই ঘোষণাপত্রের আইনি মর্যাদা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে এটি একটি রাজনৈতিক দলিল হিসেবে কার্যকর হবে, কিন্তু এর কোনো তাৎক্ষণিক আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। তবে ভবিষ্যতে এই ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে একটি আইনি দলিল প্রস্তুত করার কথাও উল্লেখ রয়েছে।

গত বছরের জুলাই মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছিল গণঅভ্যুত্থানে। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ও দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।

জুলাই ঘোষণাপত্রের ২৮তম ও শেষ দফায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “৫ আগস্ট ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হলো”। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হলো যে এই ঘোষণাপত্র কেবল সরকারি উদ্যোগ নয়, বরং সমগ্র জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।

জুলাই ঘোষণাপত্র ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না, বরং এটি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক রূপরেখা দিচ্ছে। এই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে একটি ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক ও কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে।

Share This Article