স্টাফ রিপোর্টার
২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১:০০ অপরাহ্ণ
অনলাইন সংস্করণ

শিকলে বাঁধা পা, দেবীর রূপ ভয়ংকর! জানুন হুগলির ‘বৈদ্যদের পুজো’র ইতিহাস

Kali Puja Hugli Baidyas significance: হুগলি জেলার বৈদ্যবাটি শহরে প্রতি বছর কালী পুজোর সময় এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যায়। এখানকার প্রাচীন বাক্‌শি বাড়ির পুজোয় মা কালীর মূর্তির পা শিকলে বাঁধা থাকে। দেবীর এই রূপ দেখলে যে কারও মনে ভয়ের সঞ্চার হবে। কিন্তু এর পিছনে রয়েছে এক রহস্যময় ইতিহাস।বৈদ্যবাটি শহরের নামকরণের ইতিহাস থেকেই শুরু করা যাক।

২শ শতকের শেষের দিকে বা ১৩শ শতকের গোড়ার দিকে বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের সময় বাংলার সেন রাজবংশের পতন ঘটে। সেই সময় গৌড় রাজ্য থেকে বহু বৈদ্য (চিকিৎসক) পালিয়ে এসে হুগলী নদীর তীরে আশ্রয় নেন। তাঁদের বসতি গড়ে ওঠে এই অঞ্চলে, যা পরবর্তীকালে বৈদ্যবাটি নামে পরিচিত হয়।এই বৈদ্যরা তাঁদের সঙ্গে নিয়ে আসেন দেবী পূজার ঐতিহ্য। প্রাচীন পুঁথিপত্র ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ছাড়াও তাঁরা বজায় রাখেন দেবী আরাধনার রীতি। যদিও আধুনিক দুর্গা পূজার প্রচলন হয় ১৮শ শতকে, কিন্তু তার আগে থেকেই এখানে দেবী পূজার প্রচলন ছিল বলে মনে করা হয়।বাক্‌শি বাড়ির পুজোর ইতিহাস খুঁজতে গেলে আমাদের যেতে হবে আরও কয়েক শতাব্দী পিছনে। এই বাড়ির পুরোহিত পরিবারের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, তাঁদের পূর্বপুরুষরা ১৪শ শতক থেকেই এখানে দেবী পূজা করে আসছেন।
মা কালীর মূর্তি ঘরে রাখলে কী হয়? জেনে নিন বাস্তুশাস্ত্র অনুযায়ী নিয়ম-কানুন

পুজোর সময় দেবীর পায়ের কাছে রাখা একটি ছোট্ট মূর্তি নাকি সেই প্রাচীন যুগের স্মারক।সেই সময় পুজো শুরু হত পাঁচটি বটগাছের তলায় দেবীর বোধন দিয়ে। সেই পাঁচটি বটগাছ এখনও দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সামনে, যেন প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে। ধীরে ধীরে পুজোর আয়োজন বড় হতে থাকে এবং বর্তমান রূপ পায়।কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এই পরিবারের নাম ‘বাক্‌শি’ কেন? এর পিছনেও রয়েছে দুটি ইতিহাস। একটি মতে, ১৮শ শতকের গোড়ার দিকে হুগলির নবাব কালীচরণ গুপ্তকে এই উপাধি দেন। কালীচরণ ছিলেন নবাবের চিকিৎসক। অন্য মতে, মুঘল আমলে এই পরিবারের কেউ কর বিভাগে কাজ করতেন, সেই সূত্রে তাঁরা ‘বক্‌শি’ উপাধি পান। তবে দুটি ঘটনারই ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।পরবর্তীকালে পরিবারটি ‘বাক্‌শি’ উপাধি ব্যবহার করা বন্ধ করে দেন। কিন্তু পুজোর নাম ‘বাক্‌শি বাড়ির পুজো’ হিসেবে চালু থাকে, কারণ এটাই ছিল সবার কাছে পরিচিত।এবার আসা যাক মূল প্রশ্নে – কেন মা কালীর পা শিকলে বাঁধা থাকে? এর পিছনে রয়েছে এক রোমাঞ্চকর কাহিনী।

কথিত আছে, একবার পুজোর সময় দেবী কালী এত উত্তেজিত হয়ে ওঠেন যে তিনি মূর্তি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। তাঁর তাণ্ডব নৃত্যে সারা এলাকায় ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠে। অবশেষে পুরোহিত ও পরিবারের সদস্যরা মিলে কোনোমতে তাঁকে শান্ত করে আবার মূর্তিতে ফিরিয়ে আনেন।সেই থেকে প্রতি বছর পুজোর সময় দেবীর পায়ে শিকল পরানো হয়, যাতে তিনি আর বেরিয়ে না আসেন। এই ঘটনার পর থেকেই নাকি দেবীর মূর্তির রূপ এত ভয়ংকর হয়ে গেছে। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, জিভ বের করা, হাতে খড়্গ – সবই যেন সেই ঘটনার স্মৃতি বহন করছে।বাক্‌শি বাড়ির পুজো শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অমূল্য সম্পদ। প্রতি বছর হাজার হাজার ভক্ত ও দর্শনার্থী এখানে ভিড় করেন। তাঁরা শুধু দেবীর দর্শন করেন না, দেখে যান বাংলার এক অনন্য ঐতিহ্য।

পুজোর সময় বাড়ির সামনের রাস্তায় মেলা বসে। নানা রকম খাবার, হস্তশিল্পের সামগ্রী, পুজোর উপকরণ – সবই পাওয়া যায় এই মেলায়। সন্ধ্যায় অষ্টমীর অঞ্জলির পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গান, নাচ, নাটক – সবই থাকে এই আসরে।বাক্‌শি বাড়ির পুজোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এখানে কোনো প্রাণী বলি দেওয়া হয় না। অথচ তান্ত্রিক রীতিতে কালী পুজোয় প্রাণী বলি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু এই পরিবার শুরু থেকেই নিরামিষ পুজোর রীতি অনুসরণ করে আসছেন। এটাও তাঁদের উদারতা ও প্রগতিশীল মানসিকতার পরিচায়ক।Kali Puja 2024-এর প্রসঙ্গে বলা যায়, এবছর ৩১ অক্টোবর কালী পুজো অনুষ্ঠিত হবে। বাক্‌শি বাড়িতেও সেদিন বিশেষ আয়োজন থাকবে।

লক্ষ্মীসরা: বাঙালি সংস্কৃতির অনন্য নিদর্শন – জানুন এর রহস্যময় ইতিহাস!

পুজোর শুভ মুহূর্ত হবে রাত ১১:৩৯ মিনিট থেকে ১২:২৮ মিনিট পর্যন্ত। এই সময় নিশীথকালীন পুজো অনুষ্ঠিত হবে।বাক্‌শি বাড়ির পুজো শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অমূল্য সম্পদ। এই পুজো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ধর্ম ও সংস্কৃতি কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়। প্রাচীন রীতিনীতি ও আধুনিক চিন্তাভাবনার সমন্বয় ঘটে এই পুজোয়।তাই Kali Puja 2024-এ যদি আপনি হুগলি অঞ্চলে যান, তাহলে অবশ্যই বাক্‌শি বাড়ির পুজো দেখে আসবেন। শিকলে বাঁধা মা কালীর সেই অদ্ভুত মূর্তি দেখলে আপনিও অবাক হয়ে যাবেন। আর জেনে নেবেন বাংলার এক অজানা ইতিহাস।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইউনুসের ‘নতুন’ বাংলাদেশে ধর্ষণের ঊর্ধ্বগতি: রাজপথে প্রতিবাদের ঝড় ছাত্রদের

ভারতে ইন্টারনেট বিপ্লবের নতুন দিগন্ত: স্টারলিঙ্কের সঙ্গে এয়ারটেলের ঐতিহাসিক চুক্তি

অস্ত্র আমদানির দৌড়ে শীর্ষে ইউক্রেন, ভারতের স্থান দ্বিতীয়: বিশ্বে কী বার্তা?

মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কে নজর! বঙ্গের সব আসনে লড়তে প্রস্তুত আইএমআইএম

হোলির রঙে ব্যাঙ্ক বন্ধ: আগামীকাল থেকে টানা ৪ দিন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ব্যাঙ্ক ছুটি, তালিকা দেখে নিন

কেকেআরের প্রস্তুতি শুরু: কলকাতায় নাইটদের ক্যাপ্টেন-কোচের সঙ্গে প্রকাশিত হল প্র্যাক্টিস সূচি

শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ির সামনে ‘ক্রিমিনাল’ পোস্টার: সিপিএম নেতার থানায় তলব!

কলকাতার Zakaria Street-এর মাস্ট ভিজিট ফুড স্টল: একটি খাদ্যপ্রেমীর স্বর্গভূমি

অলক্ষ্যে ঋত্বিক: ঋত্বিক ঘটকের জীবনালেখ্য নিয়ে আসছে বাঙালির প্রতীক্ষিত চলচ্চিত্র

আইপিএল-এ তামাকের বিজ্ঞাপন বন্ধ! স্বাস্থ্যমন্ত্রকের কড়া নির্দেশ জারি!

১০

দেওয়ালের কোন দিকে কোন রঙ শুভ? বাস্তুশাস্ত্রের চোখে একটি গভীর দৃষ্টিপাত

১১

ডিএলএফ-এমআরএফ-আমূল-পেটিএম: সংক্ষিপ্ত নামেই ভারত বিখ্যাত, এবার জেনে নিন এই ব্র্যান্ডগুলোর পুরো নাম!

১২

সেক্সসমনিয়া: ঘুমের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক বিরল রহস্য

১৩

ভীষণ ক্ষতিকর Non-Stick প্যানে রান্না করছেন না তো? জেনে নিন সেরা বিকল্পগুলো

১৪

কাক ডাকার ফলাফল: ইসলাম ও হিন্দু শাস্ত্রে কী বলা আছে?

১৫

দিনে ৮ ঘণ্টা AC চালালে মাসে কত ‘Electric Bill’ আসবে? সহজ হিসেবে নিশ্চিন্তে থাকুন

১৬

প্রাক্তনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কি বুদ্ধিমানের কাজ? একটি গভীর বিশ্লেষণ

১৭

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের জাদু: কীভাবে ভারত হয়ে উঠল অপ্রতিরোধ্য?

১৮

বাংলার প্রথম এসি লোকাল ট্রেন শিয়ালদা-কৃষ্ণনগর রুটে, ভাড়া কত জানেন?

১৯

ভারতে রাজ্যভিত্তিক হীরার মজুদ: কোন রাজ্য হীরা উৎপাদনে সেরা?

২০
close