নদিয়ার কালীগঞ্জে তৃণমূলের উপনির্বাচনী জয়ের বিজয় মিছিল থেকে বোমা বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছে ১০ বছরের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী তামান্না খাতুন। সোমবার বিকেলে ভোট গণনার ফলাফল প্রকাশের পরপরই ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রাজনৈতিক হিংসার বলি হওয়া এই নিষ্পাপ শিশুর মৃত্যুতে যেখানে সারা রাজ্যে নিন্দার ঝড় উঠেছে, সেখানে লক্ষণীয়ভাবে নীরব রয়েছেন অনেক শহুরে প্রতিবাদী, যারা সাধারণত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে থাকেন।
ঘটনার বিবরণ অনুযায়ী, কালীগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী আলিফা আহমেদের জয় নিশ্চিত হওয়ার পর শাসকদলের কর্মীরা বিজয় মিছিল শুরু করে। বড় চাঁদঘর পঞ্চায়েতের মোলান্দি গ্রামে এই মিছিল চলাকালীন স্থানীয় এক সিপিএম কর্মীর বাড়ির দিকে বোমা ছোড়া হয়। এই বিস্ফোরণের শিকার হয় নিহত তামান্নাসহ আরও একজন। গুরুতর আহত অবস্থায় তামান্নাকে কালীগঞ্জ প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মৃত শিশুর মা সাবিনা ইয়াসমিনের বক্তব্যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি জানান, তারা সিপিএম করেন এবং যারা বোমা ছুড়েছে তাদের মুখ চেনেন, যদিও নাম জানেন না। তার ভাষায়, “সবাই তৃণমূলের লোক”। এই বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে যে ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং পরিকল্পিত রাজনৈতিক আক্রমণ ছিল।
তৃণমূলে দুর্নীতি: তবুও সাধারণ মানুষের আস্থা কেন অবিচল?
পুলিশি তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে বলে কৃষ্ণনগর জেলা পুলিশ জানিয়েছে। প্রাথমিকভাবে একজনকে গ্রেফতার করার পর আরও তিনজন মূল অভিযুক্তকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের নাম আদর শেখ, মানোয়ার শেখ, কালু শেখ ও আনোয়ার শেখ1। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক গুরুতর ধারায় মামলা রুজু হয়েছে এবং মঙ্গলবার তাদের আদালতে পেশ করা হয়েছে।
কৃষ্ণনগরের পুলিশ সুপার অমরনাথ কে-এর মতে, কালীগঞ্জের ওই অঞ্চলে ২০২৩ সাল থেকেই দুই রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে টানাপোড়েন চলছিল। এই সংঘর্ষ সেই পুরনো দ্বন্দ্বেরই বহিঃপ্রকাশ হতে পারে বলে তিনি জানান। ফরেনসিক ও ময়নাতদন্তের রিপোর্টের অপেক্ষায় রয়েছে পুলিশ, যা পেলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও এই ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ঘটনার দিন বিকেলেই একটি পোস্ট করে তিনি জানান, দোষীদের দ্রুত শাস্তি দিতে হবে এবং পুলিশকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলেন। জয়ী তৃণমূল প্রার্থী আলিফা আহমেদও এটিকে মর্মান্তিক ঘটনা বলে উল্লেখ করে জানান, যারা এই ঘটনার পেছনে রয়েছে তারা কঠিন শাস্তি পাবে।
বিরোধী দলগুলো এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বিজেপি সাফ ভাষায় বলেছে, “রক্তপাত ছাড়া তৃণমূল জিততে জানে না”। বামফ্রন্টের দাবি অনুযায়ী, নিহত কন্যাটি তাদের এক কর্মী-সমর্থকের পরিবারের সদস্য। কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও এই হিংসার তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই ঘটনার পর নিহতের পরিবার থেকে আদালতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি এসেছে। সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, “যদি ন্যায্য ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তাহলে আদালতে যাব এবং সিবিআই তদন্তের দাবি জানাব”। এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে পরিবার স্থানীয় তদন্তের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না।
কালীগঞ্জে রাজনৈতিক হিংসার এই প্রবণতা নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরে এই অঞ্চলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘর্ষ লেগেই থাকে। নির্বাচনের সময় এই তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পায়, যার ফলে সাধারণ মানুষ হয়ে পড়ে নিরাপত্তাহীন। ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগেই এই উপনির্বাচনে একটি নিষ্পাপ শিশুর মৃত্যু ঘটেছে, যা নিয়ে ব্যাপক নিন্দা চলছে।
বিশ্লেষকদের মতে, পশ্চিমবঙ্গে গত দুই দশকে অপরাধীরা রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে। বিজয় উৎসবে মেতে উঠার নামে দেশীয় বোমা-পিস্তল নিয়ে রাস্তায় নামার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর ফলে রাজনৈতিক উৎসবগুলি হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের জন্য বিপজ্জনক।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই মর্মান্তিক ঘটনায় যেসব শহুরে প্রতিবাদী সাধারণত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, তারা তুলনামূলকভাবে নীরব রয়েছেন। অথচ অন্য রাজ্যে বা দেশে অনুরূপ ঘটনা ঘটলে তাদের তৎপরতা দেখা যায়। এই নীরবতা প্রশ্ন তুলছে তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে।
পরিশেষে বলা যায়, তামান্না খাতুনের মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের জন্য নয়, সমগ্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য একটি কালো অধ্যায়। নিহতের পরিবার এখন শুধুই চায় সুবিচার। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হয়ে যাওয়া এই নিষ্পাপ শিশুর মৃত্যু রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। এই ঘটনার ন্যায্য বিচার এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও এমন মর্মান্তিক ঘটনার আশঙ্কা রয়েই যাবে।