কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজে গত বছর ঘটে যাওয়া নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পর এবার কসবা আইন কলেজে আরেক ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। ২৫ জুন ২০২৫ তারিখে দক্ষিণ কলকাতার কসবা আইন কলেজে এক নারী শিক্ষার্থীর সাথে দলগত ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ, যাদের মধ্যে দুজন বর্তমান ছাত্র এবং একজন প্রাক্তন ছাত্র রয়েছে। ঘটনাটি আবারও পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী সুরক্ষার প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এসেছে।
প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী বিকেল ৪টার দিকে কিছু কাজে কলেজে গিয়েছিলেন। অভিযোগ অনুযায়ী, অভিযুক্তরা তাকে আরও কিছুক্ষণ থাকতে বলে এবং সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটের দিকে অন্যরা চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলে একজন অভিযুক্ত তাকে আরও কিছুক্ষণ থাকতে বলে। এরপর মূল অভিযুক্ত অন্য দুজনকে বাইরে গিয়ে দরজা বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়।
গ্রেফতারকৃত অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছে মনোজিৎ মিশ্র (৩১), যিনি কলেজের একজন কর্মী ছিলেন এবং তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা হিসেবে পরিচিত। অন্য দুজন হলেন বর্তমান ছাত্র জয়েব আহমেদ (১৯) এবং প্রমিত মুখার্জি (২০)। মনোজিৎ মিশ্রের কলেজে যথেষ্ট প্রভাব ছিল এবং কলেজের দেয়ালে তার নাম লেখা ছিল।
আর জি কর কাণ্ডে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা নীরব, দলে ভাঙন শুরু?
ভুক্তভোগীর বিবৃতি অনুযায়ী, মনোজিৎ তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল এবং প্রত্যাখ্যানের পর পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে।3 সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে সাধারণ সম্পাদক ইউনিয়ন রুম ত্যাগ করার পর মনোজিৎ ও অন্যরা দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয়।3 ভুক্তভোগীকে জোর করে ওয়াশরুমের কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। প্রতিরোধ ও আবেদন সত্ত্বেও অভিযুক্তরা তাদের অত্যাচার অব্যাহত রাখে, যার ফলে ভুক্তভোগী প্যানিক অ্যাটাক ও শ্বাসকষ্টে ভোগেন।
চিকিৎসা পরীক্ষায় দলগত ধর্ষণের অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডাক্তাররা তার শরীরে ‘জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ, কামড়ের দাগ এবং নখের আঁচড়ের’ প্রমাণ পেয়েছেন। মনোজিৎ ভুক্তভোগীকে তার প্রেমিককে হত্যা এবং পরিবারের ক্ষতি করার হুমকি দেয়। এছাড়াও সে গোপনে ভিডিও রেকর্ড করে সেগুলো প্রকাশ করার হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে।
গত বছর ৯ আগস্ট আর জি কর মেডিকেল কলেজে এক প্রশিক্ষণরত চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড সমগ্র দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এই ঘটনার পর ১৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট নিজ থেকেই মামলার জ্ঞান নেয় এবং ডাক্তারদের নিরাপত্তার জন্য একটি জাতীয় কার্যবল গঠন করে। আদালত সারাদেশে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার জন্য একটি প্রোটোকল প্রণয়নের নির্দেশ দেয়।
আর জি কর ঘটনার পর কলকাতা পুলিশ নারী নিরাপত্তার জন্য বিশেষ নির্দেশনা জারি করে। পুলিশ নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য শূন্য সহনশীলতার নীতি ঘোষণা করে।সরকারি হাসপাতাল, আবাসিক এলাকা এবং নারী হোস্টেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যালোচনার নির্দেশ দেওয়া হয়। পাবলিক স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের পাশাপাশি একটি সিসিটিভি সেল গঠনের পরিকল্পনা করা হয়।
রাজ্য স্বাস্থ্য বিভাগ সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোকে নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নিতে বলেছে। আরও সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, নারী নিরাপত্তাকর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং পুরুষ ও নারী ডাক্তারদের জন্য আলাদা ডিউটি রুম তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।প্রতিটি মেডিকেল কলেজকে কর্মপরিবেশ উন্নয়নের জন্য ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তার ও নার্সরা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক নিরাপত্তা পরামর্শ জারি করেছেন। নারী ডাক্তার ও নার্সদের রাতে একা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে চলাফেরা না করতে এবং রাত ১১টার পর দলগতভাবে চলাচলের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাদের হাসপাতালের নির্জন কক্ষে একা থাকতে নিষেধ করা হয়েছে।
Draupadi Murmu RG Kar Rape Case: “অনেক হয়েছে!” – আরজি কর কাণ্ডে রাষ্ট্রপতি অবশেষে নীরবতা ভাঙলেন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো লিঙ্গ সমতা ও নারী নিরাপত্তা শিক্ষায় নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। কলকাতার স্কুলগুলো ছেলেদের জন্য বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে। সাউথ সিটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল তাদের বার্ষিক অনুষ্ঠানে ৩৬ জন ছাত্রকে “নারী নিরাপত্তা” শপথ নিতে বলেছে। তারা ‘সম্মানের পুরুষ’ ব্যাজ পরে শপথ নিয়েছে যে তারা নারীদের মর্যাদা রক্ষা করবে।
পাঠভবন স্কুল ‘সুরক্ষা বন্ধন’ নামে একটি কার্যক্রম আয়োজন করেছে, যেখানে পঞ্চম শ্রেণি থেকে উর্ধ্বের ছেলেরা মেয়েদের হাতে ‘সুরক্ষা’ বেঁধে নারীদের সুরক্ষা ও সম্মান রক্ষার শপথ নিয়েছে। অর্কিডস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ‘মাইন্ডস্ট্রোলজি’ নামে বিশেষ সেশনের আয়োজন করেছে মানসিক শান্তির কৌশল শেখানোর জন্য।
কসবার এই সাম্প্রতিক ঘটনায় বিজেপির আইটি সেল প্রধান অমিত মালব্য বলেছেন যে পশ্চিমবঙ্গে নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধ অব্যাহত রয়েছে। তিনি ভুক্তভোগীর পরিবারের প্রতি বিজেপির সংহতি প্রকাশ করেছেন এবং সকল অভিযুক্তের বিচার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি শহরের সকল প্রতিষ্ঠানে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য একটি শক্তিশালী ব্যবস্থার জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। শিক্ষার্থী কর্মী আর্য দাস বলেছেন যে আর জি কর আন্দোলনের মতো তারা এ ক্ষেত্রেও পরিকল্পনা করছেন। তিনি বলেন, একটি শহর তখনই নিরাপদ যখন সেটি গণতান্ত্রিক স্থান প্রদান করে যেখানে মানুষ কাঠামোগত নিপীড়ন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর তুলতে পারে।
এই দুটি ঘটনা কলকাতার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী নিরাপত্তার সার্বিক অবস্থা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে এবং দেখিয়েছে যে শুধু নীতিগত পরিবর্তন নয়, বরং সমাজের মানসিকতার পরিবর্তনও প্রয়োজন।