ঐতিহাসিক মুহূর্ত আসতে চলেছে কাশ্মীর উপত্যকার জন্য! আগামী ১৯ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাটরা থেকে কাশ্মীরের প্রথম বন্দে ভারত এক্সপ্রেস ট্রেনের উদ্বোধন করবেন। এই ট্রেন সেবা কাশ্মীর উপত্যকাকে দেশের বাকি অংশের সাথে সরাসরি রেল সংযোগে যুক্ত করবে, যা ৭০ বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটাবে। শুরুতে এই ট্রেন কাটরা থেকে শ্রীনগর/বারামুল্লা পর্যন্ত চলবে এবং মাত্র ৩ ঘন্টা ১০ মিনিটে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। এই ব্লগে জানবেন বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের রুট, টাইমটেবিল এবং কাশ্মীরের অর্থনীতি ও পর্যটন শিল্পে এর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য।
কাশ্মীরের প্রথম বন্দে ভারত এক্সপ্রেস: ঐতিহাসিক মুহূর্ত
১৯ এপ্রিল ২০২৫ ভারতীয় রেলের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে। এদিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জম্মুর কাটরা থেকে কাশ্মীরের প্রথম বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের উদ্বোধন করবেন। জম্মু রেলওয়ে স্টেশনে চলমান সংস্কার কাজের কারণে এই ট্রেন প্রাথমিকভাবে কাটরা থেকে ছাড়বে। এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সাথে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ডঃ জিতেন্দ্র সিং, জম্মু ও কাশ্মীরের লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা এবং জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ সহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী পৃথিবীর সর্বোচ্চ রেল সেতু চেনাব ব্রিজও পরিদর্শন করবেন এবং কাটরায় একটি জনসভা করবেন। এই ভাবে উদ্বোধনের মাধ্যমে ২৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ উধমপুর-শ্রীনগর-বারামুল্লা রেল লিংক (USBRL) প্রকল্পের সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান
কাশ্মীর উপত্যকার সাথে সরাসরি রেল সংযোগের দাবি দীর্ঘদিনের। বর্তমানে উপত্যকার মধ্যে কেবল সাঙ্গালদান থেকে বারামুল্লা পর্যন্ত ট্রেন চলে, আর কাটরা থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ট্রেন যায়। এই নতুন সংযোগ এই দুই বিচ্ছিন্ন রেল নেটওয়ার্ককে একত্রিত করবে।
১৯৯৭ সালে কাশ্মীরকে রেল নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করার মহত্ত্বাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প শুরু হয়েছিল। কিন্তু জটিল ভূ-প্রকৃতি, প্রকৌশলগত জটিলতা এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এটি বহু বছর বিলম্বিত হয়েছিল।
বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের রুট এবং সময়সূচী
শুরুতে এই ট্রেন কাটরা থেকে শ্রীনগর/বারামুল্লা পর্যন্ত চলবে। আগস্ট মাসে জম্মু রেলওয়ে স্টেশনের সম্প্রসারণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর, ট্রেনটি জম্মু থেকে শ্রীনগর/বারামুল্লা পর্যন্ত চলবে। তবে এখনও দিল্লি থেকে শ্রীনগরের মধ্যে কোন সরাসরি ট্রেন সেবা চালু হবে না।
বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের সময়সূচী:
- কাটরা থেকে শ্রীনগর: সকাল ৮:১০ থেকে ছেড়ে সকাল ১১:২০ এ পৌঁছাবে (মোট যাত্রাকাল ৩ ঘন্টা ১০ মিনিট)
- শ্রীনগর থেকে কাটরা: দুপুর ১২:৪৫ থেকে ছেড়ে বিকেল ৩:৫৫ এ পৌঁছাবে (মোট যাত্রাকাল ৩ ঘন্টা ১০ মিনিট)
মেইল এক্সপ্রেসের সময়সূচী:
প্রতিদিন দুটি মেইল এক্সপ্রেস ট্রেনও এই রুটে চলবে:
- কাটরা থেকে শ্রীনগর:
- প্রথম ট্রেন – সকাল ৯:৫০ থেকে ছেড়ে দুপুর ১:১০ এ পৌঁছাবে
- দ্বিতীয় ট্রেন – বিকেল ৩:০০ থেকে ছেড়ে সন্ধ্যা ৬:২০ এ পৌঁছাবে
- শ্রীনগর থেকে কাটরা:
- প্রথম ট্রেন – সকাল ৮:৫৫ থেকে ছেড়ে দুপুর ১২:০৫ এ পৌঁছাবে
- দ্বিতীয় ট্রেন – বিকেল ৩:১০ থেকে ছেড়ে সন্ধ্যা ৬:৩০ এ পৌঁছাবে
উল্লেখ্য যে, নিরাপত্তা কারণে এই রুটে সমস্ত ট্রেন কেবল দিনের বেলাতেই চলবে। সন্ধ্যার পর উপত্যকায় নিরাপত্তা বাহিনী প্রত্যাহার করা হয় বলে রাতের বেলায় কোন ট্রেন চলাচল করবে না।
USBRL প্রকল্প: এক নজরে বিশেষ বৈশিষ্ট্য
উধমপুর-শ্রীনগর-বারামুল্লা রেল লিংক (USBRL) প্রকল্পটি ভারতীয় রেলের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং প্রকল্পগুলির মধ্যে একটি। এই রুটে অসংখ্য টানেল এবং ব্রিজ রয়েছে, যা এর নির্মাণকে অত্যন্ত জটিল করে তুলেছিল।
প্রকল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- মোট দৈর্ঘ্য: ২৭২ কিলোমিটার
- ৩৮টি টানেল যার মোট দৈর্ঘ্য ১১৯ কিলোমিটার
- টি-৪৯ টানেল: ভারতের দীর্ঘতম পরিবহন টানেল, যার দৈর্ঘ্য ১২.৭৫ কিলোমিটার
- ৯২৭টি ব্রিজ যা ১৩ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত
- চেনাব ব্রিজ: বিশ্বের সর্বোচ্চ রেলওয়ে আর্চ ব্রিজ, নদীতল থেকে ৩৫৯ মিটার উঁচুতে অবস্থিত, যা এফেল টাওয়ারের চেয়ে ৩৫ মিটার উঁচু
কাশ্মীরের অর্থনীতি ও পর্যটন শিল্পে প্রভাব
বন্দে ভারত এক্সপ্রেস ট্রেন শুধু একটি পরিবহন মাধ্যমই নয়, এটি কাশ্মীরের অর্থনীতির জন্য একটি গেম চেঞ্জার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
পর্যটন শিল্পে নতুন দিগন্ত
কাশ্মীরের অর্থনীতি মূলত পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভরশীল। বন্দে ভারত এক্সপ্রেস ভ্রমণকে সহজতর ও সাশ্রয়ী করে উপত্যকায় দেশীয় পর্যটকদের সংখ্যা বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। কাশ্মীর তার মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য, ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত, কিন্তু উচ্চ ভ্রমণ খরচের কারণে অনেক সময় বাজেট পর্যটকদের জন্য অ্যাক্সেসযোগ্য হয়নি।
সাশ্রয়ী রেল ভাড়া অফ-সিজন পর্যটনকেও উৎসাহিত করবে, যা আগে অত্যধিক ব্যয়বহুল বিমান ভাড়ার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। পর্যটন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যটকদের এই বর্ধিত সংখ্যা স্থানীয় বাসিন্দাদের আবাসন, আতিথেয়তা পরিষেবা, ক্যাফে এবং হস্তশিল্পের চাহিদা বাড়িয়ে সরাসরি উপকৃত করবে।
ব্যবসার জন্য নতুন সম্ভাবনা
কাশ্মীর ট্রেডার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (KTMF) এর সভাপতি মোহম্মদ ইয়াসিন বলেছেন, “এই নতুন সংযোগ একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এটি ভ্রমণকে অনেক সহজ করবে এবং নয়াদিল্লির সাথে সরাসরি সংযোগ প্রদান করবে। শীতকালে কাশ্মীরের মানুষ প্রায়ই আকাশছোঁয়া বিমান ভাড়ার কারণে বিমান ভ্রমণে সমস্যায় পড়ে। তবে, এই সংযোগের সাথে, সবাই সহজেই ভ্রমণ করতে পারবে, এবং এটি ব্যবসাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াবে।”
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, “ভ্রমণ খরচ কম হবে, এবং আগামী দিনে, যখন পণ্য পরিবহন প্রতিষ্ঠিত হবে, এটি ব্যবসা খাতের জন্য একটি সম্পূর্ণ গেম চেঞ্জার হবে। পণ্য সরাসরি দিল্লি থেকে পরিবহন করা হবে, যা সময় বাঁচাবে এবং খরচ কমাবে, শেষ পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে ব্যবসা শিল্পকে উপকৃত করবে।”
এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ফল মান্ডি সোপোরের সভাপতি ফয়াজ আহমেদ মালিকও বন্দে ভারত ট্রেনকে কাশ্মীরের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হিসেবে উল্লেখ করেছেন, কারণ এটি শুধুমাত্র ভ্রমণের সময় কমাবে না, ব্যবসায়িক সুযোগও খুলে দেবে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও বিশেষ সতর্কতা
নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগের কারণে, ট্রেন যাত্রীদের বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
- যাত্রীদের কাটরা রেলওয়ে স্টেশনে নেমে তাদের যাত্রা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অন্য ট্রেনে উঠতে হবে।
- দিল্লি থেকে শ্রীনগর বা অন্য কোন জায়গা থেকে ট্রেনে উঠা সকল ব্যক্তিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ তল্লাশি করা হবে।
- বোর্ডিংয়ের সময় তাদের লাগেজও স্ক্রিন করা হবে এবং কাটরা স্টেশনে নামার পর ডিপার্চার লাউঞ্জে আবার স্ক্যানিং করা হবে।
- অন্য ট্রেনে ওঠার আগে, তাদের আবার নিরাপত্তা কর্মীদের দ্বারা তল্লাশি করা হবে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
শুরুতে কেবল একটি কাশ্মীর-কেন্দ্রিক বন্দে ভারত ট্রেন কাটরা এবং শ্রীনগর রুটে চলবে। একজন আধিকারিক জানিয়েছেন, “জনগণের প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে আরও ট্রেন এই রুটে চলাচল শুরু করবে।”
আগস্ট ২০২৫ নাগাদ, জম্মু রেলওয়ে স্টেশনের সম্প্রসারণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর, ট্রেনটি জম্মু থেকে শ্রীনগর/বারামুল্লা পর্যন্ত চলবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে, এখনও দিল্লি থেকে শ্রীনগরের মধ্যে কোন সরাসরি ট্রেন সেবা থাকবে না।
উপসংহার
১৯ এপ্রিল ২০২৫ কাশ্মীর উপত্যকার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে চিহ্নিত হবে, যেদিন প্রথম বন্দে ভারত এক্সপ্রেস ট্রেন উদ্বোধনের মাধ্যমে এই অঞ্চল সারা দেশের সাথে রেল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত হবে। এই ঐতিহাসিক উদ্বোধন শুধু যাতায়াতের সুবিধাই নয়, কাশ্মীরের অর্থনীতি, পর্যটন শিল্প এবং সামগ্রিক উন্নয়নে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। সেরা প্রযুক্তি, আধুনিক সুবিধা এবং দ্রুত যাতায়াতের মাধ্যমে বন্দে ভারত এক্সপ্রেস ট্রেন কাশ্মীরকে ‘ভারতের স্বর্গ’ থেকে ‘সবার জন্য অ্যাক্সেসযোগ্য স্বর্গ’ হিসেবে পরিচিত করবে।