সাতক্ষীরার শ্যামনগরে অনুষ্ঠিত হয়েছে এক ব্যতিক্রমধর্মী ‘খোটা শাকের মেলা’। এই অভিনব আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রান্তিক মানুষের পুষ্টির আধার হিসেবে বিবেচিত অচাষকৃত উদ্ভিদ বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ করা। গতকাল উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের পশ্চিম জেলেখালী গ্রামে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক) এই মেলার আয়োজন করে।
মেলায় প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা থানকুনি, কলমি, হেলাঞ্চ, গাদোমনি, সেঞ্চি, বউনুটে, বুড়িপানসহ দেড় শতাধিক সবজি জাতীয় উদ্ভিদ প্রদর্শন করা হয়। এই মেলা আয়োজনের পিছনে রয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ। প্রথমত, এটি প্রান্তিক মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। দ্বিতীয়ত, এসব উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে প্রচুর ঔষধি গুণ। তৃতীয়ত, এগুলো বাঙালি সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হিসেবে কাজ করে।
মেলায় উপস্থিত গ্রামীণ নারীরা প্রদর্শিত শাকের পুষ্টিগুণ, ব্যবহার, প্রাপ্তির মৌসুম, রান্নার কৌশল ও ঔষধি গুণাগুণ তুলে ধরেন। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, কারণ এর মাধ্যমে স্থানীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চালিত হতে পারে।
“মাটি নয়, বিচার চাই”: সোনাগাছির যৌনকর্মীদের অভিনব প্রতিবাদ আরজি কর কাণ্ডে
মেলায় প্রদর্শিত উদ্ভিদের মধ্যে ছিল আমরুল, কাটানুটে, ঘুমশাক, নিশিন্দা, বিশার্লাকরনী, মনিরাজ, ধুতরা, ডুমুর, পেপুল, ঘেটকুল, লজ্বাবতী, শাপলা, কালোকচু, লাল কচু, জিবলী, সেজি, বাসক, এলোভেরা, কলার মোচা, ষষ্টিবট, শিষ বট, কলার থোড়, শালুক, নাটা, দুধশাক, দুর্বা, তুলসি। এই বিশাল তালিকা থেকে বোঝা যায় যে আমাদের চারপাশে কত বিচিত্র ধরনের উদ্ভিদ রয়েছে, যা আমরা প্রায়শই অবহেলা করি।
মেলায় উপস্থিত বক্তারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, লবণাক্ততা, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অপব্যবহার, অবহেলা এবং উৎপত্তি স্থল ধ্বংসের কারণে প্রকৃতি থেকে এসব উদ্ভিদ বৈচিত্র্য বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এটি একটি গুরুতর সমস্যা, কারণ এই উদ্ভিদগুলি শুধু পুষ্টির উৎস নয়, বরং জৈব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মেলায় বিজয়ীদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন চম্পা মাঝি, যিনি এককভাবে ১২৬ প্রকার উদ্ভিদ বৈচিত্র্য প্রদর্শন করেন। দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন কৃষাণী অনিতা গাঁতিদার ১২৫ প্রকার উদ্ভিদ প্রদর্শন করে, এবং তৃতীয় স্থান অধিকার করেন ডলি নস্কর ১১০ প্রকার উদ্ভিদ বৈচিত্র্য প্রদর্শন করে। এই সংখ্যাগুলি প্রমাণ করে যে আমাদের চারপাশে কত বিপুল সংখ্যক উদ্ভিদ রয়েছে, যা আমরা প্রায়শই লক্ষ্য করি না।
এই মেলা আয়োজনের পিছনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল। এটি সিক্সটিন ডেজ অব গ্লোবাল অ্যাকশন অন এগ্রোইকোলজি ২০২৪ ও বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবসকে সামনে রেখে আয়োজিত হয়েছিল। এর মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়ন এবং কৃষি-পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্বকে তুলে ধরা হয়েছে।
মেলায় উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিনিধিরা। ইউপি সদস্য দেবাশিষ মন্ডল, ইউপি সদস্য নীপা চক্রবর্তী, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মৃনাল কান্তি মন্ডল, কৃষক ভুধর চন্দ্র মন্ডল, স্বেচ্ছাসেবক গৌতম সরদার, কৃষাণী পূর্ণিমা রানী, লতা রাবী, শিক্ষার্থী জবা, বারসিক কর্মকর্তা রামকৃষ্ণ জোয়ারদার ও বিশ্বজিৎ মন্ডল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এই বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে এই বিষয়টি সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
এই ধরনের মেলা আয়োজন করার পিছনে রয়েছে বেশ কিছু সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য। প্রথমত, এটি স্থানীয় জ্ঞান ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত, এটি জৈব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তৃতীয়ত, এটি গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারে, কারণ এসব উদ্ভিদের চাষ ও বিক্রয় একটি নতুন আয়ের উৎস হতে পারে।
তবে, এই ধরনের উদ্যোগ সফল হতে হলে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক উদ্ভিদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। দ্বিতীয়ত, শহরায়ন ও শিল্পায়নের কারণে অনেক প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। তৃতীয়ত, নতুন প্রজন্মের মধ্যে এসব উদ্ভিদ সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব দেখা যাচ্ছে।
কাপড়ের গয়নার জনপ্রিয়তা বাড়ছে: ফ্যাশন শিল্পে নতুন যুগের সূচনা।
এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে এসব উদ্ভিদ সম্পর্কে তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এসব উদ্ভিদের সংরক্ষণ ও চাষের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, গণমাধ্যমে এসব উদ্ভিদের গুরুত্ব তুলে ধরা যেতে পারে।
উপসংহারে বলা যায়, সাতক্ষীরায় অনুষ্ঠিত ‘খোটা শাকের মেলা’ একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এটি শুধু আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির চাহিদা মেটানোর জন্য নয়, বরং আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জৈব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আশা করা যায়, এই ধরনের উদ্যোগ দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও গৃহীত হবে এবং আমরা আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদকে আরও ভালভাবে চিনতে ও সংরক্ষণ করতে পারব।