Kidney health check: শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলির মধ্যে কিডনি অন্যতম। এই ছোট্ট দুটি অঙ্গ আমাদের শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং রক্তকে ফিল্টার করে পরিশুদ্ধ রাখে। কিন্তু কীভাবে বুঝবেন আপনার কিডনি সঠিকভাবে কাজ করছে কি না? এর জন্য কিডনির পয়েন্ট অর্থাৎ কিডনির কার্যক্ষমতার মাপকাঠি জানা জরুরি। আসুন জেনে নিই কিডনির পয়েন্ট কত হলে ভালো এবং কখন চিন্তিত হওয়া উচিত।
কিডনির পয়েন্ট বা ফাংশন বুঝার গুরুত্ব
আমাদের শরীরে কিডনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন এই দুটি অঙ্গ প্রায় ১৫০ লিটার রক্ত ফিল্টার করে এবং প্রায় দেড় হাজার লিটার রক্ত পরিশোধনের কাজ করে। কিডনি রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করে প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে নিষ্কাশন করে। কিডনির কার্যক্ষমতা মাপার জন্য ডাক্তাররা বিভিন্ন পরীক্ষা করেন, যার মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ হল রক্তে ক্রিয়েটিনিন এবং জিএফআর (গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেশন রেট) নির্ণয় করা।
ক্রিয়েটিনিন হল একটি বর্জ্য পদার্থ যা আমাদের পেশী থেকে তৈরি হয়। সুস্থ কিডনি এই পদার্থকে রক্ত থেকে ফিল্টার করে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়। যখন কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়, তখন রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যায়।
স্বাভাবিক ক্রিয়েটিনিন লেভেল কত হলে ভালো
কিডনির পয়েন্ট কত হলে ভালো তা বোঝার জন্য রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা জানা প্রয়োজন। এই মাত্রা বয়স এবং লিঙ্গ অনুসারে ভিন্ন হয়।
পুরুষদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মাত্রা:
- সাধারণত প্রতি ডেসিলিটারে ০.৬-১.৬ মিলিগ্রাম (mg/dL)
- কোন কোন সূত্র অনুযায়ী ০.৭-১.৩ মিলিগ্রাম (mg/dL)
মহিলাদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মাত্রা:
- সাধারণত প্রতি ডেসিলিটারে ০.৫-১.২ মিলিগ্রাম (mg/dL)
- কোন কোন সূত্র অনুযায়ী ০.৬-১.১ মিলিগ্রাম (mg/dL)
শিশুদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মাত্রা:
- প্রতি ডেসিলিটারে ০.৩-০.৭ মিলিগ্রাম (mg/dL)
কিশোরদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মাত্রা:
- প্রতি ডেসিলিটারে ০.৫-১.০ মিলিগ্রাম (mg/dL)
যদি আপনার ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা উপরোক্ত পরিসীমার মধ্যে থাকে, তাহলে আপনার কিডনি ভালো আছে বলে ধরে নেওয়া যায়। তবে স্বাভাবিক মাত্রার বাইরে গেলেই অতিরিক্ত চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা অনেক কারণে পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন:
- পেশী ভর (যাদের পেশী বেশি, তাদের ক্রিয়েটিনিন বেশি হতে পারে)
- দেহের আকার
- খাদ্যাভ্যাস
- হাইড্রেশন লেভেল
- শারীরিক কার্যকলাপ
GFR (গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেশন রেট) কত হলে কিডনি ভালো আছে
কিডনির পয়েন্ট কত হলে ভালো তা নির্ধারণ করার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হল GFR। এটি মাপে আপনার কিডনি প্রতি মিনিটে কতটা রক্ত ফিল্টার করতে পারে। GFR মাপা হয় প্রতি মিনিটে মিলিলিটারে (ml/min/1.73m²)।
GFR এর স্বাভাবিক মাত্রা:
- সাধারণত ৯০-১২০ ml/min/1.73m²
কিডনির কার্যক্ষমতা অনুযায়ী GFR স্টেজ:
- স্টেজ ১: GFR ৯০ বা তার বেশি (সামান্য কিডনি ক্ষতি থাকতে পারে)
- স্টেজ ২: GFR ৬০-৮৯ (হালকা কিডনি ক্ষতি)
- স্টেজ ৩a: GFR ৪৫-৫৯ (হালকা থেকে মাঝারি কিডনি ক্ষতি)
- স্টেজ ৩b: GFR ৩০-৪৪ (মাঝারি থেকে তীব্র কিডনি ক্ষতি)
- স্টেজ ৪: GFR ১৫-২৯ (তীব্র কিডনি ক্ষতি)
- স্টেজ ৫: GFR ১৫ এর কম (কিডনি বিফল বা এন্ড-স্টেজ রেনাল ডিজিজ)
GFR ৬০ এর নিচে নেমে গেলে তা কিডনি রোগের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। GFR যত কম, কিডনি ক্ষতির মাত্রা তত বেশি।
কিডনি পরীক্ষার প্রকারভেদ
কিডনির পয়েন্ট কত হলে ভালো তা নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষাগুলো একত্রে রেনাল প্রোফাইল টেস্ট নামে পরিচিত।
সিরাম ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা:
এটি একটি রক্ত পরীক্ষা যা রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নির্ণয় করে। এই পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে কিডনির কার্যক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
অ্যালবুমিন পরীক্ষা:
এটি একটি প্রস্রাব পরীক্ষা। অ্যালবুমিন হল রক্তে পাওয়া একটি প্রোটিন। সুস্থ কিডনি প্রস্রাবে অ্যালবুমিন পাস করে না। প্রস্রাবে অ্যালবুমিনের উপস্থিতি কিডনির ক্ষতির ইঙ্গিত দেয়। ৩০ মিলিগ্রামের কম প্রস্রাবের অ্যালবুমিন স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়।
ইউরিয়া পরীক্ষা:
এই পরীক্ষা রক্তে নাইট্রোজেন-ঘটিত বর্জ্য পদার্থের মাত্রা পরিমাপ করে। উচ্চ মাত্রার ইউরিয়া কিডনি ফাংশন হ্রাসের লক্ষণ হতে পারে।
ইলেক্ট্রোলাইট টেস্ট:
কিডনি শরীরে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং ফসফেট জাতীয় ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখে। এই পরীক্ষা এসব ইলেক্ট্রোলাইটের মাত্রা নির্ণয় করে।
কিডনির পয়েন্ট কত হলে ডায়ালাইসিস প্রয়োজন
যখন কিডনি তার কাজ সঠিকভাবে করতে পারে না, তখন ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হতে পারে। ডায়ালাইসিস হল একটি প্রক্রিয়া যা কৃত্রিমভাবে রক্ত পরিশোধন করে।
ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয় যখন:
- ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা ৭.০ mg/dL বা তার বেশি হয়
- GFR ১৫ ml/min/1.73m² এর কম হয়
- কিডনি ব্যর্থতার লক্ষণগুলো দেখা দেয় (যেমন: শ্বাসকষ্ট, শরীরে তরল জমা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণহীন হওয়া)
অনেকের মধ্যে একটি ভুল ধারণা আছে যে ডায়ালাইসিস শুরু হলে রোগী বেশিদিন বাঁচে না। বাস্তবে, নিয়মিত ডায়ালাইসিস এবং সঠিক চিকিৎসা দ্বারা অনেকেই দীর্ঘদিন সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে পারেন। তবে অনিয়মিত ডায়ালাইসিস নানা শারীরিক জটিলতা বাড়িয়ে দিতে পারে।
কিডনির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়
কিডনির পয়েন্ট কত হলে ভালো তা জানার পাশাপাশি কিডনি স্বাস্থ্যকর রাখার উপায়গুলো জানাও জরুরি।
পর্যাপ্ত পানি পান করুন:
দৈনিক অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন। এতে কিডনি সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য পায়।
খাদ্যাভ্যাস সামলান:
- লবণ কম খান
- প্রচুর ফল ও শাকসবজি খান
- প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন
- অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ এড়িয়ে চলুন
নিয়মিত ব্যায়াম করুন:
স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
ধূমপান ও মদ্যপান এড়িয়ে চলুন:
এগুলো কিডনির কার্যক্ষমতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান:
বিশেষ করে যদি আপনার ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ অথবা পারিবারিক কিডনি রোগের ইতিহাস থাকে, তাহলে নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করানো উচিত।
ওষুধ সেবনে সতর্কতা:
অনেক ব্যথানাশক ওষুধ (যেমন আইবুপ্রোফেন) দীর্ঘদিন সেবন করলে কিডনির ক্ষতি হতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এসব ওষুধ দীর্ঘদিন সেবন এড়িয়ে চলুন।
কিডনির পয়েন্ট কত হলে ভালো তা জানা আমাদের সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত পুরুষদের ক্ষেত্রে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা ০.৬-১.৬ mg/dL এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ০.৫-১.২ mg/dL হলে তা স্বাভাবিক। আবার GFR ৯০ বা তার বেশি থাকলে কিডনি ভালো আছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
মনে রাখবেন, কিডনির কার্যক্ষমতা হ্রাসের প্রাথমিক অবস্থায় কোনো লক্ষণ নাও দেখা দিতে পারে। তাই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে আপনার কিডনি সম্পর্কে সচেতন থাকুন। আর যদি কোনো সময় কিডনির পয়েন্ট স্বাভাবিকের বাইরে যায়, তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং সঠিক চিকিৎসা দ্বারা কিডনির স্বাস্থ্য দীর্ঘদিন বজায় রাখা সম্ভব।