সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়, চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে বা হাঁটার সময় হঠাৎ হাঁটুর মধ্যে ‘কট’ বা ‘পপ’ শব্দ শুনে চমকে উঠেছেন? এই অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই। এই ধরনের শব্দকে ডাক্তারি ভাষায় ‘ক্রেপিটাস’ (Crepitus) বলা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই শব্দ নিরীহ এবং চিন্তার কোনো কারণ নেই। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এটি হতে পারে গুরুতর কোনো সমস্যার প্রাথমিক লক্ষণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে, বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মাস্কুলোস্কেলিটাল (Musculoskeletal) সমস্যায় ভুগছেন, যার মধ্যে হাঁটুর সমস্যা অন্যতম। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাঁটুর অস্টিওআর্থ্রাইটিসের মতো রোগের প্রকোপ বাড়ছে, যা হাঁটুতে শব্দ এবং ব্যথার অন্যতম প্রধান কারণ। এই প্রবন্ধে আমরা Knee Popping বা হাঁটুতে শব্দ হওয়ার পেছনের সাধারণ ও গুরুতর কারণগুলো বিশ্লেষণ করব এবং কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত ও এর প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
হাঁটুতে শব্দ (Knee Popping) কেন হয়? সাধারণ কারণ
হাঁটুর ভেতরের গঠন বেশ জটিল। এখানে হাড়, তরুণাস্থি (cartilage), লিগামেন্ট এবং টেন্ডন রয়েছে। এদের নড়াচড়ার সময় বিভিন্ন কারণে শব্দ হতে পারে। সাধারণ এবং নিরীহ কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- গ্যাস বা বাতাসের বুদবুদ (Cavitation): আমাদের অস্থিসন্ধির ভেতরে এক ধরনের তরল পদার্থ থাকে, যা সাইনোভিয়াল ফ্লুইড (Synovial Fluid) নামে পরিচিত। এই তরলে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো গ্যাস দ্রবীভূত থাকে। যখন আমরা দ্রুত হাঁটু ভাঁজ করি বা সোজা করি, তখন এই তরলের উপর চাপ কমে যায় এবং গ্যাসগুলো ছোট ছোট বুদবুদ তৈরি করে। এই বুদবুদগুলো ফেটেই ‘পপ’ বা ‘কট’ শব্দের সৃষ্টি হয়। এটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া এবং এতে ব্যথার কোনো অনুভূতি থাকে না।
- লিগামেন্ট ও টেন্ডনের চলাচল: হাঁটু ভাঁজ বা সোজা করার সময় লিগামেন্ট (হাড়কে হাড়ের সাথে যুক্ত করে) বা টেন্ডন (পেশিকে হাড়ের সাথে যুক্ত করে) সামান্য সরে গিয়ে হাঁটুর কোনো অংশের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময়ও এ ধরনের শব্দ হতে পারে। এটি সাধারণত টাইট লিগামেন্ট বা টেন্ডনের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায় এবং ব্যায়াম বা স্ট্রেচিংয়ের মাধ্যমে এটি ঠিক করা সম্ভব।
কখন Knee Popping চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়?
যদি হাঁটুতে শব্দের সাথে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা যায়, তবে তা কোনো গুরুতর সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে এবং দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত:
- ব্যথা (Pain): যদি কটকট শব্দের সাথে তীব্র বা হালকা ব্যথা অনুভূত হয়।
- ফোলা ভাব (Swelling): শব্দের পরে যদি হাঁটু ফুলে যায় বা গরম অনুভূত হয়।
- লকিং বা আটকে যাওয়া (Locking): হাঁটু ভাঁজ বা সোজা করার সময় যদি হঠাৎ আটকে যায়।
- অস্থিরতা (Instability): যদি মনে হয় হাঁটু আপনার শরীরের ভার নিতে পারছে না বা যেকোনো মুহূর্তে ঘুরে যেতে পারে।
- নড়াচড়ার সীমাবদ্ধতা (Limited Range of Motion): যদি হাঁটু পুরোপুরি সোজা বা ভাঁজ করতে কষ্ট হয়।
এই লক্ষণগুলো থাকলে তার পেছনে কিছু প্যাথলজিক্যাল বা রোগ সংক্রান্ত কারণ থাকতে পারে।
গুরুতর কারণসমূহ
- অস্টিওআর্থ্রাইটিস (Osteoarthritis): এটি আর্থ্রাইটিসের সবচেয়ে সাধারণ রূপ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাঁটুর জয়েন্টের সুরক্ষাকারী তরুণাস্থি বা কার্টিলেজ ক্ষয় হতে শুরু করে। ফলে হাড়গুলো একে অপরের সাথে ঘষা খায় এবং কটকট শব্দ ও তীব্র ব্যথার সৃষ্টি হয়। দ্য ল্যানসেট রিউম্যাটোলজি (The Lancet Rheumatology) জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী অস্টিওআর্থ্রাইটিসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে তা প্রায় এক বিলিয়নে পৌঁছাতে পারে। ভারতে প্রায় ২২% থেকে ৩৯% মানুষ এই সমস্যায় আক্রান্ত। এই রোগের কারণে হাঁটুতে শব্দ হওয়া একটি সাধারণ লক্ষণ।
- মেনিস্কাস টিয়ার (Meniscus Tear): মেনিস্কাস হলো হাঁটুর জয়েন্টের ভেতরে থাকা ‘C’ আকৃতির একটি নরম কিন্তু শক্তিশালী কার্টিলেজ, যা শক অ্যাবজরবার হিসেবে কাজ করে। হঠাৎ হাঁটু মচকে গেলে, খেলাধুলা বা দুর্ঘটনার কারণে মেনিস্কাস ছিঁড়ে যেতে পারে। মেনিস্কাস টিয়ার হলে হাঁটু নাড়ানোর সময় ছেঁড়া অংশটি জয়েন্টের মধ্যে আটকে গিয়ে Knee Popping শব্দ এবং লকিংয়ের মতো সমস্যা তৈরি করতে পারে।
- লিগামেন্ট ইনজুরি (Ligament Injury): অ্যান্টেরিয়র ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট (ACL) বা পোস্টেরিয়র ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট (PCL) এর মতো গুরুত্বপূর্ণ লিগামেন্টগুলো ছিঁড়ে গেলে হাঁটুতে অস্থিরতা এবং পপিং শব্দ হতে পারে। আমেরিকান একাডেমি অফ অর্থোপেডিক সার্জনস (AAOS) এর মতে, খেলাধুলায় জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে ACL ইনজুরি খুব সাধারণ।
- প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সিনড্রোম (Patellofemoral Pain Syndrome – PFPS): এটি “রানার্স নী” (Runner’s Knee) নামেও পরিচিত। এক্ষেত্রে হাঁটুর মালাইচাকি বা প্যাটেলা (Patella) ফিমার (Femur) হাড়ের ওপর মসৃণভাবে চলাচল করতে পারে না। এর ফলে হাঁটার সময় বা সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় মালাইচাকির নিচে ঘষা লেগে শব্দ ও ব্যথা হতে পারে।
হাঁটুতে শব্দ প্রতিরোধের উপায় ও করণীয়
যদি আপনার Knee Popping নিরীহ প্রকৃতির হয়, তবে কিছু জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং ঘরোয়া প্রতিকারের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
সঠিক ব্যায়াম ও স্ট্রেচিং
হাঁটুর চারপাশের পেশী, বিশেষ করে কোয়াড্রিসেপস (Quadriceps) এবং হ্যামস্ট্রিং (Hamstrings) শক্তিশালী হলে তা জয়েন্টের ওপর চাপ কমায়।
- স্ট্রেচিং: ব্যায়ামের আগে ও পরে হ্যামস্ট্রিং এবং কোয়াড্রিসেপস স্ট্রেচিং করুন।
- শক্তি বাড়ানোর ব্যায়াম: লেগ প্রেস, স্কোয়াটস (সঠিক ভঙ্গিমায়), এবং স্ট্রেট লেগ রেইজ (Straight Leg Raises) বেশ কার্যকর।
- কম প্রভাবের ব্যায়াম: সাঁতার এবং সাইক্লিংয়ের মতো ব্যায়ামগুলো হাঁটুর ওপর কম চাপ সৃষ্টি করে জয়েন্টকে সচল রাখতে সাহায্য করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ
শরীরের অতিরিক্ত ওজন হাঁটুর জয়েন্টের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, শরীরের ওজন ১ কেজি কমালে হাঁটুর ওপর চাপ প্রায় ৪ কেজি পর্যন্ত কমে যায়। সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা অস্টিওআর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি কমাতে অত্যন্ত সহায়ক, যা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC) দ্বারা সমর্থিত।
সঠিক খাদ্যাভ্যাস
হাঁটুর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কিছু পুষ্টি উপাদান খুবই জরুরি:
- ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি: হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। দুধ, দই, চিজ, এবং সবুজ শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। ভিটামিন ডি-এর জন্য সূর্যের আলো এবং তৈলাক্ত মাছ উপকারী।
- ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড: এটি প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। সামুদ্রিক মাছ, ফ্ল্যাক্সসিড এবং আখরোটে ওমেগা-৩ পাওয়া যায়।
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: রঙিন ফল ও সবজিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট জয়েন্টের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
R.I.C.E. মেথড
হালকা ব্যথা বা আঘাতের ক্ষেত্রে R.I.C.E. পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে:
- Rest (বিশ্রাম): হাঁটুতে চাপ দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
- Ice (বরফ): ফোলা ও ব্যথা কমাতে ১৫-২০ মিনিটের জন্য বরফের প্যাক ব্যবহার করুন।
- Compression (চাপ): ক্রেপ ব্যান্ডেজ দিয়ে হাঁটুতে হালকা চাপ দিয়ে রাখুন।
- Elevation (উত্তোলন): পা উঁচু করে রাখুন যাতে ফোলা কমে যায়।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন?
আগেই যেমন বলা হয়েছে, যদি শব্দের সাথে ব্যথা, ফোলা, লকিং বা অস্থিরতার মতো লক্ষণ থাকে, তবে দেরি না করে একজন অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। চিকিৎসক শারীরিক পরীক্ষার পাশাপাশি এক্স-রে (X-ray) বা এমআরআই (MRI) এর মতো পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু করতে পারেন।
উপসংহার
হাঁটুর Knee Popping বা কটকট শব্দ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া। যতক্ষণ না এর সাথে ব্যথা বা অন্য কোনো অস্বস্তিকর লক্ষণ যুক্ত হচ্ছে, ততক্ষণ এটি নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তবে, স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, নিয়মিত ব্যায়াম এবং সঠিক ওজন বজায় রাখার মাধ্যমে হাঁটুর জয়েন্টকে সুস্থ রাখা সম্ভব। নিজের শরীরের কথা শুনুন এবং যেকোনো অস্বাভাবিক লক্ষণে সতর্ক হন। মনে রাখবেন, প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করা গেলে অনেক গুরুতর সমস্যা সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সচরাচর জিজ্ঞাস্য (FAQ Section)
১. হাঁটুতে শব্দ হওয়া কি আর্থ্রাইটিসের লক্ষণ? উত্তর: সব ক্ষেত্রে নয়। যদি শব্দের সাথে 지속 ব্যথা, সকালে হাঁটু জমে থাকা এবং ফোলাভাব থাকে, তবে এটি অস্টিওআর্থ্রাইটিসের লক্ষণ হতে পারে। শুধুমাত্র শব্দ হওয়া, বিশেষ করে ব্যথা না থাকলে, তা সাধারণত গ্যাসের বুদবুদ বা লিগামেন্টের স্বাভাবিক নড়াচড়ার কারণে হয়।
২. ব্যথা ছাড়াই হাঁটুতে ঘন ঘন শব্দ হলে কী করব? উত্তর: যদি কোনো ব্যথা বা ফোলা না থাকে, তবে এটি সাধারণত ক্ষতিকর নয়। আপনি হাঁটুর মাংসপেশি শক্তিশালী করার জন্য ব্যায়াম (যেমন- কোয়াড্রিসেপস স্ট্রেন্থেনিং) করতে পারেন। এটি জয়েন্টের স্থিতিশীলতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
৩. হাঁটুতে শব্দ কমানোর জন্য কি কোনো সাপ্লিমেন্ট খাওয়া উচিত? উত্তর: গ্লুকোসামিন এবং কনড্রয়েটিন সালফেট-এর মতো সাপ্লিমেন্টগুলো জয়েন্টের স্বাস্থ্যের জন্য অনেকেই ব্যবহার করেন, যদিও এর কার্যকারিতা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ভিন্ন মত রয়েছে। যেকোনো সাপ্লিমেন্ট নেওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৪. কোন ধরনের জুতো পরা উচিত? উত্তর: আরামদায়ক এবং সঠিক মাপের জুতো পরা উচিত যা আপনার পা-কে ভালোভাবে সাপোর্ট দেয়। হাই হিল বা অতিরিক্ত ফ্ল্যাট জুতো এড়িয়ে চলুন, কারণ এগুলো হাঁটুর ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
৫. আমার হাঁটু সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বেশি শব্দ করে, কেন? উত্তর: সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় হাঁটুর ওপর শরীরের ওজনের কয়েকগুণ বেশি চাপ পড়ে। এই সময় প্যাটেলোফেমোরাল জয়েন্টে (মালাইচাকি ও ফিমারের সংযোগস্থল) বেশি চাপ সৃষ্টি হয়, যা শব্দ হওয়ার একটি সাধারণ কারণ। যদি ব্যথা না থাকে, তবে এটি নিয়ে চিন্তার কারণ নেই।