২০২৪ সালের দুর্গাপূজায় কলকাতার পণ্ডেলগুলিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং ভার্চুয়াল রিয়ালিটি (VR) প্রযুক্তির ব্যবহার একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই প্রযুক্তিগুলি পরম্পরাগত উৎসবকে একটি অভিনব ও অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতায় পরিণত করেছে।
কলকাতার দুর্গাপূজা, যা ইউনেস্কো কর্তৃক “অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে স্বীকৃত, এখন প্রযুক্তির সাথে সংযুক্ত হয়ে একটি নতুন রূপ পেয়েছে। AI-চালিত পণ্ডেল ভ্রমণের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে VR-ভিত্তিক ৩৬০-ডিগ্রি ভার্চুয়াল টুর পর্যন্ত, প্রযুক্তি এই উৎসবকে একটি সম্পূর্ণ ইমার্সিভ অভিজ্ঞতায় পরিণত করেছে।
ThePujaApp নামক একটি ক্লাউড-ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন ২০১৩ সাল থেকে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ব্যবহার করে কলকাতার ৩০০টিরও বেশি দুর্গাপূজা পণ্ডেলের শিল্পকর্মকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে। এই অ্যাপটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায় এবং সমস্ত আধুনিক ব্রাউজারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
Fake App Fraud: ডিজিটাল জঙ্গলে সাবধান, ভুয়া অ্যাপের ফাঁদ এড়ানোর গোপন কৌশল
AI-এর ব্যবহার শুধুমাত্র দর্শকদের অভিজ্ঞতাকেই সমৃদ্ধ করেনি, বরং পণ্ডেল পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনাকেও উন্নত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, একজন আইটি পেশাদার ChatGPT-এর সাহায্যে চার দিনের একটি পণ্ডেল ভ্রমণের পরিকল্পনা তৈরি করেছেন, যা শহরের বিভিন্ন অংশের পণ্ডেলগুলি অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং দ্রুততম রুট এবং খাবারের জায়গার সুপারিশও প্রদান করেছে।
VR প্রযুক্তি ব্যবহার করে, দর্শকরা এখন Oculus-এর মাধ্যমে পণ্ডেলগুলি অনুভব করতে পারেন। ১৫K উচ্চ রেজোলিউশনের প্যানোরামা ভিউ পণ্ডেলের প্রতিটি সূক্ষ্ম বিবরণ ধারণ করে, যা দর্শকদের একটি আর্ট ইনস্টলেশনের মধ্যে থাকার অনুভূতি দেয়। ড্রোন শট ব্যবহার করে কলকাতার স্কাইলাইনের মধ্যে পণ্ডেলগুলির অবস্থান দেখানো হয়। ভক্তিমূলক সঙ্গীত, ঢাকের শব্দ এবং শহরের কোলাহল মিলে একটি সম্পূর্ণ অডিও-ভিজুয়াল অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
এই প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনগুলি শুধুমাত্র দর্শকদের জন্যই নয়, শিল্পীদের জন্যও উপকারী। উচ্চ রেজোলিউশনের ছবিগুলি শিল্পীদের তাদের কাজের সূক্ষ্ম ত্রুটিগুলি চিহ্নিত করতে সাহায্য করে, যা মূর্তি ও পণ্ডেলের চূড়ান্ত রূপ নিখুঁত করতে সহায়তা করে।
২০২৪ সালে, কলকাতার দুর্গাপূজার অর্থনীতি প্রায় ৫০,০০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এই বিশাল অর্থনৈতিক প্রভাব বিভিন্ন খাতে বিস্তৃত, যেমন ইনস্টলেশন, শিল্প ও সজ্জা, মূর্তি নির্মাণ, আলোকসজ্জা, সাহিত্য ও প্রকাশনা, স্পনসরশিপ, বিজ্ঞাপন, খুচরা ব্যবসা, শিল্প ও ডিজাইন, চলচ্চিত্র ও বিনোদন এবং খাদ্য ও পানীয়।
লালাবাগানের একটি পরিবেশবান্ধব পণ্ডেল ৮,০০০টি জীবন্ত গাছ ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছে, যা পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে। অন্যদিকে, সল্টলেকের একটি পণ্ডেল বৃষ্টির জলের সংরক্ষণের বার্তা দিয়েছে, যেখানে জলের ফোঁটার শব্দ পুজোর ঢাকের তালে মিলিয়ে একটি অনন্য শব্দ পরিবেশ তৈরি করেছে।
চেতলা আগ্রনী ক্লাবের পণ্ডেল বারাণসীর ঘাটের প্রতিকৃতি তৈরি করেছে, যেখানে গঙ্গা আরতি এবং “হর হর মহাদেব” ধ্বনি পুরো পরিবেশকে পবিত্র করে তুলেছে। জগৎ মুখার্জি পার্কের পণ্ডেল কলকাতার মেট্রো রেল সিস্টেমকে পুনঃনির্মাণ করেছে, যা জীবন্ত ট্রেন মডেল এবং সূক্ষ্ম বিবরণ সহ একটি অনন্য দৃশ্য অভিজ্ঞতা প্রদান করেছে।
কাশী বোস লেনের পণ্ডেল সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধকরণে বাংলার ভূমিকাকে তুলে ধরেছে, একই সাথে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সামাজিক বার্তা প্রদান করেছে। দক্ষিণপাড়ার পণ্ডেলটি বর্জ্য সামগ্রী, যেমন যন্ত্রপাতি ও ধাতব পাত দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, যা সৃজনশীলতার সাথে পরিবেশ সচেতনতাকে তুলে ধরেছে।
২০২২ সালে কলকাতায় প্রায় ৩,০০০টি বারোয়ারি পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যার মধ্যে ২০০টিরও বেশি পূজার বাজেট ছিল এক কোটি টাকারও বেশি। এই সংখ্যাগুলি ২০২৪ সালে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
দুর্গাপূজা কার্নিভাল, যা ২০১৬ সালে শুরু হয়েছিল, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ২০২০ এবং ২০২১ সালে বন্ধ থাকার পর ২০২২ সাল থেকে আবার শুরু হয়েছে। এই কার্নিভাল উৎসবের সমাপ্তিকে আরও বর্ণময় করে তোলে।
২০২১ সালে, ব্রিটিশ কাউন্সিল ইন ইন্ডিয়া ২০১৯ সালের দুর্গাপূজার সৃজনশীল অর্থনীতিকে ৩২,০০০ কোটি টাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং জানিয়েছে যে এই উৎসব ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে পশ্চিমবঙ্গের জিডিপিতে ২.৫৮% অবদান রেখেছিল।
সামগ্রিকভাবে, কলকাতার দুর্গাপূজা ২০২৪ সালে AI এবং VR প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার একটি অপূর্ব সমন্বয় প্রদর্শন করেছে। এই প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনগুলি উৎসবের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে, একই সাথে এর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব ও অর্থনৈতিক প্রভাবকে বজায় রেখেছে। ফলস্বরূপ, কলকাতার দুর্গাপূজা এখন শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং একটি বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক ঘটনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা ঐতিহ্য, শিল্প, প্রযুক্তি এবং সামাজিক সচেতনতার একটি অনন্য সংমিশ্রণ প্রদর্শন করে।