Kolkata-Dhaka First Flight: বাংলার দুই প্রান্তের মানুষের মধ্যে যোগাযোগের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হলো কলকাতা ঢাকা আকাশ পথে প্রথম বিমান উড্ডয়নের ঘটনা। এই বিশেষ দিনটি শুধুমাত্র পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতির দিক থেকেই নয়, বরং দুই বাংলার মানুষের হৃদয়ের যোগসূত্র তৈরির ক্ষেত্রেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আজকের এই লেখায় আমরা জানব সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের কথা, যখন প্রথমবার আকাশপথে যাত্রা শুরু হয়েছিল কলকাতা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে।
১৯৩৩ সালের ১ ডিসেম্বর: ইতিহাসের সোনালি দিন
কলকাতা ঢাকা আকাশ পথে প্রথম বিমান উড়েছিল ১৯৩৩ সালের ১ ডিসেম্বর। এই ঐতিহাসিক দিনে সকাল ৭টায় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল এয়ারওয়েজের একটি ড্রাগন প্লেন “দ্য রুবি” দমদম এয়ারোড্রোম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। এটি ছিল অফিসিয়াল এয়ার মেইল সার্ভিসের উদ্বোধনী ফ্লাইট, যা সকাল ৮টা ২০ মিনিটে ঢাকায় পৌঁছেছিল।
এই প্রথম ফ্লাইটে ছিল চারজন যাত্রী এবং প্রায় ৫.৫ পাউন্ড ওজনের ডাক, যার মধ্যে প্রায় ১৭৬টি আইটেম ছিল। এই বিশেষ ডাকের উপর লেখা ছিল “First Official Flight Indian National Airways”।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার: আপনার সন্তানের স্বাস্থ্যসেবার সেরা গন্তব্য
প্রথম রিটার্ন ফ্লাইটের গৌরব
একই দিনে বিকেল ৩টায় ঢাকা থেকে “দ্য রুবি” কলকাতার উদ্দেশ্যে ফিরতি যাত্রা শুরু করে এবং সন্ধ্যা ৫টা ৩০ মিনিটে দমদম এয়ারোড্রোমে পৌঁছায়। এই রিটার্ন ফ্লাইটে ছিল তিনজন যাত্রী এবং ৩২ পাউন্ড ওজনের ডাক।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল এয়ারওয়েজের পথচলা
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল এয়ারওয়েজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্রিটিশ শিল্পপতি R.E. Grant Govan। তিনি শুধু বিমান সংস্থার প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না, বরং ভারতে ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণ বোর্ড এবং ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়ার সহ-প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন। সরকারি এয়ারমেইল চুক্তির ভিত্তিতেই এই এয়ারলাইনটি গঠিত হয়েছিল।
১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই এয়ারলাইনটি প্রায় দেড় থেকে দুই বছর পর্যন্ত ঢাকা ও কলকাতার মধ্যে নিয়মিত বিমান চলাচল অব্যাহত রেখেছিল। শুধু ঢাকা ও কলকাতাই নয়, কলকাতা এবং আসামের মধ্যেও তারা ফ্লাইট চালু করেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত পর্যাপ্ত যাত্রীর অভাবে এই রুটগুলো বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।
কলকাতা বিমানবন্দরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
কলকাতার দমদম বিমানবন্দর ১৯২৪ সাল থেকেই বিমান চলাচলের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে আসছে। ১৯৩০ সালে এই বিমানবন্দরে প্রথম রানওয়ে তৈরি করা হয়। এই বিমানবন্দরটি ঐতিহ্যগতভাবে ইউরোপ থেকে ইন্দোচীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বিমান পথের কৌশলগত যাত্রাবিরতি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে।
বিমান চলাচলের আগের ইতিহাস
কলকাতা ঢাকা আকাশ পথে প্রথম বিমান চলাচলের আগে এই অঞ্চলে বিমান চলাচলের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস রয়েছে। ১৯২৯ সালে ব্রিটেনের ইম্পেরিয়াল এয়ারওয়েজ লন্ডন ও করাচির মধ্যে সপ্তাহে নিয়মিতভাবে একটি ফ্লাইট চালু করেছিল।
১৯৩৩ সালে ‘ট্রান্স কন্টিনেন্টাল এয়ারওয়েজ’ নাম দিয়ে আরেকটি এয়ারলাইন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা করাচি-দিল্লী-কলকাতা ও রেঙ্গুন হয়ে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত সপ্তাহে অন্তত একটি ফ্লাইট পরিচালনা করত।
স্বাধীনতার পর নতুন যুগ
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস (পিআইএ) গঠিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী ঢাকায় অবস্থিত বেশিরভাগ বিমান পাকিস্তানে নিয়ে গিয়েছিল।
বাংলাদেশ বিমানের যাত্রা শুরু
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বিমান তার যাত্রা শুরু করেছিল মাত্র একটি ডাকোটা প্লেন নিয়ে। ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি এই ডাকোটা প্লেন নিয়ে বাংলাদেশ বিমান ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে প্রথম যাত্রী বহনের কাজ শুরু করেছিল।
কলকাতা ঢাকা রুটে নিয়মিত সেবা প্রদানের জন্য ১৯৭২ সালের ৩ মার্চ ভারত থেকে একটি ফকার এফ-২৭ আনা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে ঢাকা-কলকাতা রুটে নিয়মিত দুটি ফ্লাইট পরিচালনার জন্য আরও চারটি ফকার এফ-২৭ আনা হয়েছিল।
আধুনিক যুগের কলকাতা-ঢাকা বিমান সেবা
বর্তমানে কলকাতা-ঢাকা রুটে একাধিক এয়ারলাইনস সেবা প্রদান করে থাকে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ছাড়াও ইন্ডিগো এয়ারলাইন্স, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, নভোএয়ার এয়ারলাইন্স, এয়ার ইন্ডিয়া এয়ারলাইন্স, স্পাইস জেট এয়ারলাইন্স, রিজেন্ট এয়ারওয়েস এই রুটে ফ্লাইট চালায়।
কোভিড-১৯ মহামারীর পর এয়ার বাবল চুক্তির আওতায় ২০২১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা-কলকাতা রুটে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা পুনরায় শুরু হয়েছে।
ভারতের ঐতিহাসিক ঘটনা: ২৩ জুনে ঘটে যাওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত
বিমান চলাচলের সামাজিক প্রভাব
কলকাতা ঢাকা আকাশ পথে প্রথম বিমান চলাচলের ফলে দুই বাংলার মানুষের মধ্যে যোগাযোগ অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। এই বিমান সেবা শুধুমাত্র যাত্রী পরিবহনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং ডাক ব্যবস্থার উন্নতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
প্রথম দিনেই ১৭৬টি ডাক আইটেম পরিবহন করা হয়েছিল, যা সেই সময়ের জন্য একটি বিপ্লবী উদ্যোগ ছিল। এই সেবা ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রেও নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছিল।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব
আজকের দিনে কলকাতা-ঢাকা বিমান পরিষেবা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, পর্যটন, এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এই রুটের বিমান ভাড়া সাশ্রয়ী হওয়ায় সাধারণ মানুষের কাছেও এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
উপসংহার
১৯৩৩ সালের ১ ডিসেম্বর কলকাতা ঢাকা আকাশ পথে প্রথম বিমান উড্ডয়নের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই যাত্রা আজও অব্যাহত রয়েছে। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল এয়ারওয়েজের “দ্য রুবি” বিমানটির সেই ঐতিহাসিক উড্ডয়ন শুধুমাত্র পরিবহন ইতিহাসেই নয়, বরং দুই বাংলার মানুষের হৃদয়ের মেলবন্ধনেও একটি স্মরণীয় মাইলফলক হয়ে রয়েছে। আজকের আধুনিক বিমান সেবা সেই প্রথম উড্ডয়নের স্বপ্নকেই বাস্তবায়িত করেছে এক নতুন মাত্রায়।
এই লেখাটি আপনার কাছে কেমন লাগল? মন্তব্যে জানাতে ভুলবেন না। আরও এমন আকর্ষণীয় ইতিহাসের গল্প পড়তে আমাদের সাথেই থাকুন।