কলকাতার ট্রাম বন্ধ হয়ে যাওয়ার এই সিদ্ধান্ত অনেক মানুষের কাছে বেদনাদায়ক। বহু প্রজন্ম ধরে ট্রাম ছিল কলকাতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর সাথে জড়িয়ে আছে অসংখ্য স্মৃতি ও আবেগ।পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৪৭ সালে কলকাতায় প্রতিদিন গড়ে ৭৫০,০০০ যাত্রী ট্রামে ভ্রমণ করতেন। ১৯৮০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫০,০০০ থেকে ৯০০,০০০ এর মধ্যে। কিন্তু ২০১৯ সালে এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় মাত্র ১০,০০০ এ।ট্রাম বন্ধের সিদ্ধান্তের ফলে প্রায় ২,৬০০ কর্মচারী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাদের মধ্যে অনেকেই চাকরি হারাবেন। সরকার জানিয়েছে যে তারা এই কর্মচারীদের অন্যান্য বিভাগে স্থানান্তর করার চেষ্টা করবে।
কলকাতা ট্রামওয়েজ কোম্পানির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “আমরা বুঝতে পারছি যে ট্রাম চালানো আর্থিকভাবে লাভজনক নয়। কিন্তু এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও পরিবেশগত সুবিধার কথা বিবেচনা করে এটি চালু রাখা উচিত ছিল। অন্তত কয়েকটি প্রধান রুটে ট্রাম চালু রাখা যেত।”পরিবেশবিদরা মনে করছেন, ট্রাম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কলকাতার বায়ু দূষণ আরও বাড়বে। একজন পরিবেশবিদ বলেছেন, “ট্রাম ছিল একটি নিঃসরণমুক্ত পরিবহন মাধ্যম। এর বদলে আরও বেশি বাস ও গাড়ি রাস্তায় নামলে কার্বন নিঃসরণ বাড়বে। এটি শহরের বায়ু মানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
শহরের একজন প্রবীণ নাগরিক বলেছেন, “আমার ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে ট্রামের সাথে। স্কুলে যাওয়া-আসা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা – সবই ট্রামে করতাম। এখন সেই দিনগুলো আর ফিরে পাব না। ট্রাম ছিল কলকাতার প্রাণ, যা এখন হারিয়ে যাচ্ছে।”অনেক পর্যটক ও ঐতিহ্য প্রেমী মানুষ মনে করছেন, ট্রাম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কলকাতার একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ হারিয়ে যাচ্ছে। একজন পর্যটক বলেছেন, “আমি প্রতি বছর কলকাতায় আসি। ট্রামে চড়া ছিল আমার কাছে একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এখন সেই অভিজ্ঞতা আর পাব না।”যদিও সরকার একটি রুটে ‘হেরিটেজ রাইড’ হিসেবে ট্রাম চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অনেকে মনে করছেন এটি যথেষ্ট নয়। তারা চান ট্রামকে আধুনিকীকরণ করে আরও বেশি রুটে চালানো হোক।
কলকাতার ৪টি অজানা পুরনো বই বাজার: কলেজস্ট্রীটের বাইরেও রয়েছে বইপ্রেমীদের স্বর্গ!
Calcutta Tram Users Association-এর সদস্য অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “আমরা চাই ট্রামকে আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে সাজানো হোক। দ্রুতগামী, আরামদায়ক ও নিরাপদ ট্রাম চালু করা হোক। এটি করলে মানুষ আবার ট্রামে চড়বে। অন্য দেশগুলোতে দেখুন, তারা কীভাবে ট্রামকে আধুনিকীকরণ করেছে।”পরিবহন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ট্রাম বন্ধের পরিণতি হিসেবে কলকাতার রাস্তায় যানজট আরও বাড়বে। একজন পরিবহন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, “ট্রাম একটি নির্দিষ্ট ট্র্যাকে চলত। এখন সেই জায়গায় আরও বেশি গাড়ি চলবে। এতে যানজট বাড়বে। ট্রাম একসঙ্গে অনেক যাত্রী বহন করতে পারত, যা যানজট কমাতে সাহায্য করত।”
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ট্রাম বন্ধের সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে আর্থিকভাবে লাভজনক নাও হতে পারে। একজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, “ট্রাম চালানোর খরচ কম। এটি দীর্ঘস্থায়ী। অন্যদিকে বাস বা অন্যান্য গাড়ির জন্য জ্বালানি খরচ বেশি। দীর্ঘমেয়াদে ট্রাম চালানো আর্থিকভাবে লাভজনক হতে পারত।”ট্রাম বন্ধের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। অনেকে #SaveKolkataTram হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। একজন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী লিখেছেন, “ট্রাম শুধু একটি পরিবহন মাধ্যম নয়, এটি কলকাতার আত্মা। এটি বন্ধ করে আমরা আমাদের ঐতিহ্য হারাচ্ছি।”
কিছু মানুষ অবশ্য সরকারের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছেন। তারা মনে করেন, ট্রাম এখন অপ্রয়োজনীয় এবং এটি যানজটের একটি কারণ। একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী বলেছেন, “ট্রামের জন্য অনেক সময় রাস্তায় যানজট হয়। এটি বন্ধ হলে যানজট কমবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ হবে।”তবে অধিকাংশ মানুষই চান ট্রাম থাকুক, তবে আধুনিক রূপে। তারা চান ট্রামকে নতুন করে সাজিয়ে, আরও দ্রুতগামী ও আরামদায়ক করে চালু করা হোক।কলকাতার ট্রাম বন্ধের এই সিদ্ধান্ত শুধু একটি পরিবহন মাধ্যম বন্ধ হওয়ার ঘটনা নয়, এটি একটি যুগের অবসান।
১৫১ বছরের ইতিহাস, লক্ষ লক্ষ মানুষের স্মৃতি, একটি শহরের পরিচয় – সবকিছু মিলিয়ে ট্রাম ছিল কলকাতার প্রাণ। এখন সেই প্রাণ হারিয়ে যাচ্ছে।তবে আশার কথা হল, সরকার একটি রুটে ‘হেরিটেজ রাইড’ হিসেবে ট্রাম চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি অন্তত কলকাতার ট্রামের স্মৃতিকে কিছুটা হলেও ধরে রাখবে। ভবিষ্যতে হয়তো আবার ট্রাম ফিরে আসতে পারে, নতুন রূপে, নতুন প্রযুক্তিতে। তবে সেই দিন আসা পর্যন্ত, কলকাতার মানুষ তাদের প্রিয় ট্রামের জন্য অপেক্ষা করবে, স্মৃতিচারণ করবে।