Kolkata tram service shutdown: কলকাতার রাস্তায় ১৫১ বছর ধরে চলা ঐতিহ্যবাহী ইলেকট্রিক ট্রাম পরিষেবা আজ থেকে বন্ধ হয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ২০২৪ সাল থেকে শুধুমাত্র একটি রুটে ট্রাম চালানো হবে, তাও কেবল পর্যটন ও বিনোদনের উদ্দেশ্যে। এই সিদ্ধান্তের ফলে এশিয়ার প্রাচীনতম ট্রাম ব্যবস্থা ইতিহাসের পাতায় চলে যাচ্ছে।
১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় প্রথম ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালু হয় শিয়ালদা থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত। ১৮৮০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কলকাতায় ট্রাম চালু হয় এবং লন্ডনে Calcutta Tramways Company গঠিত হয়। ১৯০২ সাল থেকে কলকাতায় বৈদ্যুতিক ট্রাম চলতে শুরু করে। দীর্ঘ সময় ধরে ট্রাম ছিল কলকাতার পরিবহন ব্যবস্থার মেরুদণ্ড।পশ্চিমবঙ্গ পরিবহন দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “১৯৬৯ সালে যখন Calcutta Tramways Company সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছিল, তখন মোট ট্র্যাকের দৈর্ঘ্য ছিল ৭০.৭৪ কিলোমিটার। বর্তমানে আমরা মাত্র তিনটি রুটে ট্রাম চালাচ্ছি – গড়িয়াহাট থেকে এস্প্ল্যানেড, টালিগঞ্জ থেকে বালিগঞ্জ এবং এস্প্ল্যানেড থেকে শ্যামবাজার।”
কলকাতার ট্রামের একাল ও সেকাল: ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন
কলকাতার ট্রামের একাল ও সেকাল: ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন
১৯৯২ সালে তৎকালীন পরিবহন মন্ত্রী শ্যামল চক্রবর্তী একটি জনসভায় বলেছিলেন যে ট্রাম “অপ্রচলিত হয়ে গেছে এবং স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করবে”। West Bengal Transport Corporation (WBTC)-এর তথ্য অনুযায়ী, এমনকি এক দশক আগেও যখন ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় আসে, তখনও অন্তত ৩৭টি ট্রাম রুট ছিল যার মোট ট্র্যাক দৈর্ঘ্য ছিল ৬০ কিলোমিটারের বেশি।১৯৭০-৭১ সালে হাওড়া বিভাগের ট্রাম পরিষেবা প্রথম বন্ধ হয়। তারপর থেকে একের পর এক ট্রাম রুট বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে ট্রাম কেবল তিনটি রুটে চলে যার মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৮ কিলোমিটার।কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে ট্রাম চালানো আর আর্থিকভাবে লাভজনক নয়, তাই পরিবহনের জন্য ট্রাম ব্যবহার বন্ধ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। “
কলকাতায় একসময় ট্রাম ছিল পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। যখন লিসবন, ডাবলিন এবং বার্লিনের মতো অনেক দেশে ট্রাম পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে, তখন কলকাতায় নানা অজুহাতে ট্রাম লাইন বন্ধ করা হচ্ছিল। যানজট সৃষ্টি করছে, পরিচালনাগত সমস্যা এবং ট্রাম ট্র্যাকে বাইক আরোহীরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন – এই সব অভিযোগ তুলে ট্রামকে খলনায়ক বানানো হয়েছিল। ট্রাম কোম্পানির সম্পত্তি বিক্রি করা হয়েছে বা লিজ দেওয়া হয়েছে,” বলেছেন Calcutta Tram Users Association-এর সভাপতি দেবাশিস ভট্টাচার্য।তিনি আরও বলেন, “এখন সরকার বিদ্যমান তিনটি রুটও বন্ধ করে দিতে চায় এবং এস্প্ল্যানেড-খিদিরপুর ‘ঐতিহ্যবাহী’ ট্রাম রুটটি পুনরুজ্জীবিত করতে চায়। এই বিষয়টি এই মাসের প্রথম দিকে একটি বৈঠকে উঠে এসেছে যেখানে শহরের মেয়র সভাপতিত্ব করেছিলেন এবং রাজ্যের পরিবহন মন্ত্রী, পরিবহন সচিব এবং পুলিশ কমিশনারসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।”
কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “তবে মাঠের মধ্য দিয়ে খিদিরপুর থেকে এস্প্ল্যানেড পর্যন্ত রুটটি ঐতিহ্যবাহী ট্র্যাক হিসেবে সংরক্ষণ করা যেতে পারে কারণ এর অস্তিত্ব স্বাভাবিক যানচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে না এবং সড়ক নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে না। এছাড়াও, ট্রাম রক্ষণাবেক্ষণ ও সমীক্ষার জন্য এস্প্ল্যানেড থেকে নোনাপুকুরে অবস্থিত ট্রাম ডিপো পর্যন্ত ট্রাম ট্র্যাক রাখা যেতে পারে।”WBTC-এর একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে গত তিন-চার বছর ধরে বাস, ট্যাক্সি এবং মেট্রোর পাশাপাশি অন্য একটি পরিবহন মাধ্যম হিসেবে নয়, বরং একটি ভিন্ন রূপে ট্রাম পুনরায় চালু করার চেষ্টা চলছে। ছয়টি উৎসবভিত্তিক থিমযুক্ত ট্রাম ইতিমধ্যে চালু করা হয়েছে। “ট্রামকে এখন একটি কাম্য পরিবেশবান্ধব ঐতিহ্যবাহী পরিবহন মাধ্যম হিসেবে স্থাপন করা হচ্ছে।”ট্রাম বন্ধের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়। ২০২৩ সালে আরেকটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়।
প্রধান বিচারপতি টি.এস. শিবগণানমের নেতৃত্বাধীন একটি ডিভিশন বেঞ্চ ট্রাম পরিষেবা পুনরুদ্ধারের জন্য একটি ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করে।ট্রাম বন্ধের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ট্রাম ভক্তরা বলছেন, ট্রাম বাসের তুলনায় বেশি যাত্রী বহন করতে পারে, বাসের চেয়ে বেশি টেকসই, নির্দিষ্ট ট্র্যাকে চলে বলে নিরাপদ এবং পরিবেশবান্ধব। তারা মনে করেন, ট্রাম বন্ধ করার বদলে এর আধুনিকীকরণ করা উচিত।পশ্চিমবঙ্গের পরিবহন মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী বলেছেন, “ভারতের অন্তত ১৫টি শহরে একসময় ট্রাম ছিল কিন্তু এখন শুধু কলকাতাতেই আছে। অন্য শহরগুলো কেন ট্রাম তুলে দিল? পশ্চিমবঙ্গ পরিবেশবান্ধব যানবাহন চালু করার ক্ষেত্রে অগ্রণী, এখানে তুলনামূলকভাবে কম যানজট ও দুর্ঘটনা হয়। আমাদের এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। আমরা ইতিমধ্যে আদালতকে জানিয়েছি যে ট্রাম একটি ট্র্যাকেই চলবে। আমরা সেগুলো প্রত্যাহার করছি।”
ট্রাম বন্ধের এই সিদ্ধান্ত কলকাতার ঐতিহ্য ও পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ট্রাম ছিল কলকাতার পরিচয়, যা এখন হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশবান্ধব এই পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শহরের বায়ু দূষণ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অনেকে মনে করছেন, ট্রামের বিকল্প হিসেবে আরও বেশি বাস ও গাড়ি রাস্তায় নামবে, যা যানজট বাড়াবে।তবে সরকার মনে করছে, ট্রাম চালানো আর্থিকভাবে লাভজনক নয় এবং এটি যানজটের একটি কারণ। তাই তারা মনে করছেন একটি রুটে শুধু পর্যটন ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য ট্রাম চালানোই যুক্তিযুক্ত।
কলকাতার ট্রাম বন্ধ হয়ে যাওয়ার এই সিদ্ধান্ত অনেক মানুষের কাছে বেদনাদায়ক। বহু প্রজন্ম ধরে ট্রাম ছিল কলকাতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর সাথে জড়িয়ে আছে অসংখ্য স্মৃতি ও আবেগ।পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৪৭ সালে কলকাতায় প্রতিদিন গড়ে ৭৫০,০০০ যাত্রী ট্রামে ভ্রমণ করতেন। ১৯৮০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫০,০০০ থেকে ৯০০,০০০ এর মধ্যে। কিন্তু ২০১৯ সালে এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় মাত্র ১০,০০০ এ।ট্রাম বন্ধের সিদ্ধান্তের ফলে প্রায় ২,৬০০ কর্মচারী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাদের মধ্যে অনেকেই চাকরি হারাবেন। সরকার জানিয়েছে যে তারা এই কর্মচারীদের অন্যান্য বিভাগে স্থানান্তর করার চেষ্টা করবে।
কলকাতা ট্রামওয়েজ কোম্পানির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “আমরা বুঝতে পারছি যে ট্রাম চালানো আর্থিকভাবে লাভজনক নয়। কিন্তু এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও পরিবেশগত সুবিধার কথা বিবেচনা করে এটি চালু রাখা উচিত ছিল। অন্তত কয়েকটি প্রধান রুটে ট্রাম চালু রাখা যেত।”পরিবেশবিদরা মনে করছেন, ট্রাম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কলকাতার বায়ু দূষণ আরও বাড়বে। একজন পরিবেশবিদ বলেছেন, “ট্রাম ছিল একটি নিঃসরণমুক্ত পরিবহন মাধ্যম। এর বদলে আরও বেশি বাস ও গাড়ি রাস্তায় নামলে কার্বন নিঃসরণ বাড়বে। এটি শহরের বায়ু মানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
শহরের একজন প্রবীণ নাগরিক বলেছেন, “আমার ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে ট্রামের সাথে। স্কুলে যাওয়া-আসা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা – সবই ট্রামে করতাম। এখন সেই দিনগুলো আর ফিরে পাব না। ট্রাম ছিল কলকাতার প্রাণ, যা এখন হারিয়ে যাচ্ছে।”অনেক পর্যটক ও ঐতিহ্য প্রেমী মানুষ মনে করছেন, ট্রাম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কলকাতার একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ হারিয়ে যাচ্ছে। একজন পর্যটক বলেছেন, “আমি প্রতি বছর কলকাতায় আসি। ট্রামে চড়া ছিল আমার কাছে একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এখন সেই অভিজ্ঞতা আর পাব না।”যদিও সরকার একটি রুটে ‘হেরিটেজ রাইড’ হিসেবে ট্রাম চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অনেকে মনে করছেন এটি যথেষ্ট নয়। তারা চান ট্রামকে আধুনিকীকরণ করে আরও বেশি রুটে চালানো হোক।
কলকাতার ৪টি অজানা পুরনো বই বাজার: কলেজস্ট্রীটের বাইরেও রয়েছে বইপ্রেমীদের স্বর্গ!
কলকাতার ৪টি অজানা পুরনো বই বাজার: কলেজস্ট্রীটের বাইরেও রয়েছে বইপ্রেমীদের স্বর্গ!
Calcutta Tram Users Association-এর সদস্য অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “আমরা চাই ট্রামকে আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে সাজানো হোক। দ্রুতগামী, আরামদায়ক ও নিরাপদ ট্রাম চালু করা হোক। এটি করলে মানুষ আবার ট্রামে চড়বে। অন্য দেশগুলোতে দেখুন, তারা কীভাবে ট্রামকে আধুনিকীকরণ করেছে।”পরিবহন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ট্রাম বন্ধের পরিণতি হিসেবে কলকাতার রাস্তায় যানজট আরও বাড়বে। একজন পরিবহন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, “ট্রাম একটি নির্দিষ্ট ট্র্যাকে চলত। এখন সেই জায়গায় আরও বেশি গাড়ি চলবে। এতে যানজট বাড়বে। ট্রাম একসঙ্গে অনেক যাত্রী বহন করতে পারত, যা যানজট কমাতে সাহায্য করত।”
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ট্রাম বন্ধের সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে আর্থিকভাবে লাভজনক নাও হতে পারে। একজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, “ট্রাম চালানোর খরচ কম। এটি দীর্ঘস্থায়ী। অন্যদিকে বাস বা অন্যান্য গাড়ির জন্য জ্বালানি খরচ বেশি। দীর্ঘমেয়াদে ট্রাম চালানো আর্থিকভাবে লাভজনক হতে পারত।”ট্রাম বন্ধের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। অনেকে #SaveKolkataTram হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। একজন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী লিখেছেন, “ট্রাম শুধু একটি পরিবহন মাধ্যম নয়, এটি কলকাতার আত্মা। এটি বন্ধ করে আমরা আমাদের ঐতিহ্য হারাচ্ছি।”
কিছু মানুষ অবশ্য সরকারের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছেন। তারা মনে করেন, ট্রাম এখন অপ্রয়োজনীয় এবং এটি যানজটের একটি কারণ। একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী বলেছেন, “ট্রামের জন্য অনেক সময় রাস্তায় যানজট হয়। এটি বন্ধ হলে যানজট কমবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ হবে।”তবে অধিকাংশ মানুষই চান ট্রাম থাকুক, তবে আধুনিক রূপে। তারা চান ট্রামকে নতুন করে সাজিয়ে, আরও দ্রুতগামী ও আরামদায়ক করে চালু করা হোক।কলকাতার ট্রাম বন্ধের এই সিদ্ধান্ত শুধু একটি পরিবহন মাধ্যম বন্ধ হওয়ার ঘটনা নয়, এটি একটি যুগের অবসান।
১৫১ বছরের ইতিহাস, লক্ষ লক্ষ মানুষের স্মৃতি, একটি শহরের পরিচয় – সবকিছু মিলিয়ে ট্রাম ছিল কলকাতার প্রাণ। এখন সেই প্রাণ হারিয়ে যাচ্ছে।তবে আশার কথা হল, সরকার একটি রুটে ‘হেরিটেজ রাইড’ হিসেবে ট্রাম চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি অন্তত কলকাতার ট্রামের স্মৃতিকে কিছুটা হলেও ধরে রাখবে। ভবিষ্যতে হয়তো আবার ট্রাম ফিরে আসতে পারে, নতুন রূপে, নতুন প্রযুক্তিতে। তবে সেই দিন আসা পর্যন্ত, কলকাতার মানুষ তাদের প্রিয় ট্রামের জন্য অপেক্ষা করবে, স্মৃতিচারণ করবে।