রেকর্ড বৃষ্টিতে ভেসে গেল কলকাতা, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত ১০! দায় এড়াল CESC, প্রশ্নবিদ্ধ পুর পরিষেবা

স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও একবিংশ শতাব্দীর তিলোত্তমা কলকাতা সাক্ষী থাকল এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডির। সোমবার রাত থেকে শুরু হওয়া রেকর্ডভাঙা বৃষ্টিতে জলমগ্ন শহর যেন এক মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছিল। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত…

Chanchal Sen

 

স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও একবিংশ শতাব্দীর তিলোত্তমা কলকাতা সাক্ষী থাকল এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডির। সোমবার রাত থেকে শুরু হওয়া রেকর্ডভাঙা বৃষ্টিতে জলমগ্ন শহর যেন এক মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছিল। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত পাওয়া খবরে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অন্তত ৯ জন নাগরিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনার পরেই শহর জুড়ে উঠেছে একটাই প্রশ্ন — এই মৃত্যুর দায় কার? একদিকে রাজ্যের শাসকদল সরাসরি কাঠগড়ায় তুলেছে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা CESC-কে, অন্যদিকে CESC সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট বা ট্র্যাফিক সিগন্যালের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাদের নয়। এই চাপানউতোরের মাঝে চাপা পড়ে যাচ্ছে শহরের পরিকাঠামোগত দুর্বলতা এবং প্রশাসনিক গাফিলতির আসল চিত্র।

এই বিপর্যয় শুধু কিছু পরিবারের স্বপ্নই শেষ করেনি, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নাগরিক সুরক্ষার নগ্ন রূপ। পূজাের মুখে এই ঘটনায় শোকস্তব্ধ গোটা শহর। প্রশাসন ও বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে দায়িত্ব নিয়ে টানাপোড়েন চললেও, সাধারণ মানুষ জানতে চায় এর শেষ কোথায়

এক নজরে মূল তথ্য

  • মৃতের সংখ্যা: বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ৭ থেকে ১০-এর মধ্যে ঘোরাফেরা করলেও, পিটিআই (PTI) সূত্রে খবর, অন্তত ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে।
  • রেকর্ড বৃষ্টি: আবহাওয়া দফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় শহরে প্রায় ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা গত কয়েক দশকে সর্বোচ্চ। গড়িয়াহাট, বালিগঞ্জ, একবালপুর, বেহালা, নেতাজি নগর সহ একাধিক এলাকা থেকে মৃত্যুর খবর এসেছে।
  • দায়িত্ব নিয়ে সংঘাত: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই দুর্ঘটনার জন্য সরাসরি CESC-র গাফিলতিকে দায়ী করেছেন এবং মৃতদের পরিবারকে চাকরি ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
  • CESC-র পাল্টা জবাব: CESC এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, রাস্তার ত্রিফলা বাতিস্তম্ভ বা ট্র্যাফিক সিগন্যালের মালিকানা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাদের নয়। তাদের মতে, বেশিরভাগ মৃত্যুই হয়েছে এই সব পোল থেকে বা বাড়ির অভ্যন্তরীণ ওয়্যারিংয়ের ত্রুটির কারণে।
  • সিস্টেমের ফাটল: এই ঘটনায় কলকাতা পৌরনিগম (KMC), পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট (PWD) এবং CESC-র মতো একাধিক সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং দায়িত্বের অস্পষ্টতা প্রকট হয়েছে।

কী ঘটেছিল? দুর্যোগের রাতের ভয়াবহ চিত্র

সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫) মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া প্রবল বৃষ্টিতে ভোরের মধ্যেই শহরের অধিকাংশ এলাকা কোমর-জলে ডুবে যায়। পরিবহণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। আর এই জলমগ্ন রাস্তাই হয়ে ওঠে মৃত্যুফাঁদ।

  • নেতাজি নগর: সকালে ৭০ বছর বয়সী ফল বিক্রেতা বাবু কুণ্ডু জলমগ্ন রাস্তায় একটি বাতিস্তম্ভে হাত দিলে সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান।
  • বেনিয়াপুকুর ও একবালপুর: চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের কাছে এবং একবালপুরের হোসেন শাহ রোডে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আরও দুজনের মৃত্যু হয়। মৃতদের মধ্যে ফিরোজ আলি খান (৫০) এবং মুমতাজ বিবি (৭০) বলে শনাক্ত করা হয়েছে।
  • অন্যান্য এলাকা: গড়িয়াহাটের বালিগঞ্জ প্লেস, কালিকাপুর, মোমিনপুর, বেহালা এবং হরিদেবপুরেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। সাইকেল আরোহী থেকে শুরু করে সাধারণ পথচারী, অনেকেই জলমগ্ন রাস্তায় বিদ্যুতের তার বা ল্যাম্পপোস্টের সংস্পর্শে এসে প্রাণ হারান।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, অনেক জায়গাতেই বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে জলের মধ্যে পড়ে ছিল অথবা ল্যাম্পপোস্টের সুইচ বক্স খোলা ছিল, যা এই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

দায় কার? সরকার বনাম CESC

এই ধারাবাহিক মৃত্যুর পরেই শুরু হয়েছে তীব্র দোষারোপের পালা। প্রতিটি সংস্থাই নিজেদের গা থেকে দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে।

সরকারের অভিযোগ

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনাকে ‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দিয়ে সরাসরি CESC-কে নিশানা করেছেন। তিনি বলেন:

“বিদ্যুৎ সরবরাহ করে CESC, আমরা নই। মানুষের যাতে এই ধরনের ভোগান্তি না হয়, তা নিশ্চিত করা তাদেরই দায়িত্ব। এখানে ব্যবসা করবে, অথচ পরিকাঠামোর আধুনিকীকরণ করবে না? আমি স্পষ্ট বলছি, মৃতদের পরিবারকে CESC-কেই চাকরি দিতে হবে।”।

রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আরও অভিযোগ করা হয়েছে যে, বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও CESC তাদের ভূগর্ভস্থ তার এবং ডিস্ট্রিবিউশন বক্সগুলির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ করেনি। জল জমার পরে কোন কোন এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে, সেই বিষয়েও তারা তৎপর ছিল না বলে অভিযোগ।

CESC-র আত্মপক্ষ সমর্থন

অন্যদিকে, CESC যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছে। মঙ্গলবার  জারি করা এক বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে:

“আমরা স্পষ্ট করে জানাতে চাই যে রাস্তার বাতিস্তম্ভ এবং ট্র্যাফিক লাইটের মালিকানা, রক্ষণাবেক্ষণ বা পরিচালনার দায়িত্বে CESC নেই।”।

CESC-র দাবি, যে ক’টি মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, তার মধ্যে কয়েকটি বাড়ির ভেতরের ত্রুটিপূর্ণ ওয়্যারিংয়ের কারণে ঘটেছে। বাকিগুলি পৌরসভা বা অন্য সরকারি সংস্থার অধীনস্থ ল্যাম্পপোস্ট বা ট্র্যাফিক সিগন্যাল থেকে হয়েছে। অর্থাৎ, তাদের ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক থেকে সরাসরি বিদ্যুৎ লিক করে এই দুর্ঘটনা ঘটেনি।

পরিকাঠামোর জট: আসল দায়িত্ব কার?

CESC-র এই বিবৃতির পর প্রশ্ন উঠছে, তাহলে রাস্তার বৈদ্যুতিক খুঁটিগুলির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আদতে কার? এই বিষয়ে কোনও একটি সংস্থার স্পষ্ট দায়বদ্ধতা খুঁজে পাওয়া কঠিন, যা এই সমস্যার মূল কারণ।

  • কলকাতা পৌরনিগম (KMC): নিয়ম অনুযায়ী, শহরের রাস্তার আলো, ত্রিফলা বাতিস্তম্ভ এবং সেগুলির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কলকাতা পৌরনিগমের বিদ্যুৎ বিভাগের। অতীতেও বাতিস্তম্ভ থেকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় KMC-র গাফিলতির অভিযোগ উঠেছিল। ২০২২ সালের একটি ঘটনায় তদন্তে দেখা গিয়েছিল যে বাতিস্তম্ভটির ‘আর্থিং’ করা ছিল না ।
  • পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট (PWD): শহরের প্রধান রাস্তা এবং উড়ালপুলের ট্র্যাফিক সিগন্যাল ও আলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব PWD-র। অনেক ক্ষেত্রে একাধিক সংস্থার কাজ মিলেমিশে থাকায় দায়িত্বের সীমানা অস্পষ্ট হয়ে যায়।
  • সমন্বয়ের অভাব: বিভিন্ন টেন্ডারের নথি থেকে দেখা যায়, ট্র্যাফিক সিগন্যালের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ বিভিন্ন সময়ে PWD, KMDA বা স্থানীয় পৌরসংস্থাগুলি করে থাকে। এই একাধিক সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবই বিপদের মূল কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞের মতামত

বিশিষ্ট বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞ এবং আরবান প্ল্যানাররা এই ঘটনাকে একটি ‘সিস্টেম ফেলিওর’ বা পরিকাঠামোগত ব্যর্থতা হিসেবেই দেখছেন।

একজন অবসরপ্রাপ্ত বিদ্যুৎকর্মী নাম না প্রকাশের শর্তে জানিয়েছেন, “শুধু দোষারোপ করলে চলবে না। প্রতি বছর বর্ষার আগে কেন শহরের সমস্ত বৈদ্যুতিক পোল, বিশেষ করে যেগুলি জলমগ্ন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, সেগুলির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় না? প্রতিটি পোলের সঠিক আর্থিং (Earthing) আছে কিনা, সুইচ বক্সগুলি জলরোধী (waterproof) কিনা, এবং কোনওভাবে বিদ্যুৎ লিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার জন্য একটি নির্দিষ্ট প্রোটোকল থাকা উচিত। CESC, KMC এবং PWD-কে একসাথে বসে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।”

পরিসংখ্যানে পুনরাবৃত্তি

কলকাতায় বর্ষায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু কোনও নতুন ঘটনা নয়। প্রতি বছরই এই ধরনের দুর্ঘটনার সাক্ষী থাকে শহর।

বছর ঘটনা সূত্র
২০২১ উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকায় জলমগ্ন রাস্তায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ETV Bharat
২০২২ হরিদেবপুরে একটি বাতিস্তম্ভ ছুঁয়ে ১২ বছরের এক কিশোরের মৃত্যু হয়। তদন্তে KMC-র গাফিলতি উঠে আসে। The Times of India
২০২৫ এক দিনে রেকর্ড বৃষ্টিতে অন্তত ৯ জনের মৃত্যু। PTI, The Hindu

এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, পূর্বের দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে কোনও স্থায়ী সমাধান সূত্র বের করা হয়নি।

সাধারণ মানুষের কথা

এই ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলির যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। নেতাজি নগরে মৃত ফল বিক্রেতার এক প্রতিবেশী বলেন, “সকালবেলাতেও মানুষটার সঙ্গে কথা বললাম। কে জানত যে রাস্তায় বেরোলেই এভাবে মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে! এই জলের মধ্যে কোথায় কারেন্ট আছে, কে বলবে? আমাদের জীবনের কি কোনও দাম নেই?”।

পরবর্তী পদক্ষেপ ও উপসংহার

এই ভয়াবহ ট্র্যাজেডির পর কয়েকটি প্রশ্ন অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে:

১. রাজ্য সরকার কি একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রতিটি মৃত্যুর কারণ এবং তার জন্য দায়ী নির্দিষ্ট সংস্থা ও ব্যক্তিকে চিহ্নিত করবে?

২. CESC, KMC এবং PWD-র মধ্যে দায়িত্ব স্পষ্ট করে একটি সুনির্দিষ্ট আইন বা নিয়মাবলী কি তৈরি করা হবে?

৩. আগামী দিনে এই ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে পরিকাঠামোগত কী কী পরিবর্তন আনা হবে?

যতদিন না এই প্রশ্নগুলির উত্তর মিলবে এবং দোষীদের শাস্তি হবে, ততদিন কলকাতার রাজপথ বর্ষার জলে  মৃত্যুফাঁদ থেকে যাবে। শুধু ক্ষতিপূরণ বা চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই গভীর ক্ষতের নিরাময় সম্ভব নয়। প্রয়োজন সিস্টেমের আমূল সংস্কার এবং প্রতিটি নাগরিকের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দৃঢ় রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক সদিচ্ছা।

About Author
Chanchal Sen

চঞ্চল সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক। তিনি একজন অভিজ্ঞ লেখক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক, যিনি পলিটিক্স নিয়ে লেখালিখিতে পারদর্শী। চঞ্চলের লেখায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের গভীর বিশ্লেষণ এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর সঠিক উপস্থাপন পাঠকদের মুগ্ধ করে। তার নিবন্ধ এবং মতামতমূলক লেখা বস্তুনিষ্ঠতা ও বিশ্লেষণধর্মিতার কারণে পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। চঞ্চল সেনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং গভীর গবেষণা তাকে রাজনৈতিক সাংবাদিকতার জগতে একটি স্বতন্ত্র স্থান প্রদান করেছে। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে পাঠকদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এবং সমাজে পরিবর্তন আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন।