শহরের বুকে বিপর্যয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় উপহাসের ঢেউ এবং আমাদের হারানো সংবেদনশীলতা

একদিকে রেকর্ড ভাঙা বৃষ্টিতে ভাসছে কলকাতা, মৃত্যু হচ্ছে সহ নাগরিকের, আশ্রয়হীন বহু পরিবার। অন্যদিকে, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম জুড়ে সেই বিপর্যয়কে নিয়েই চলছে মিম আর হাসির রোল। জলমগ্ন শহরের ছবি দিয়ে তৈরি…

Avatar

 

একদিকে রেকর্ড ভাঙা বৃষ্টিতে ভাসছে কলকাতা, মৃত্যু হচ্ছে সহ নাগরিকের, আশ্রয়হীন বহু পরিবার। অন্যদিকে, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম জুড়ে সেই বিপর্যয়কে নিয়েই চলছে মিম আর হাসির রোল। জলমগ্ন শহরের ছবি দিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের কৌতুক। এই দ্বিচারিতা এক কঠিন প্রশ্ন তুলে ধরেছে – প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে দাঁড়িয়ে ডিজিটাল সমাজ কি তার ন্যূনতম সংবেদনশীলতাটুকুও হারিয়ে ফেলছে?

গত ৪৮ ঘন্টায় কলকাতায় রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে, যার ফলে শহরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলমগ্ন। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে যখন উদ্ধারकार्य চলছে এবং সাধারণ মানুষ একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে, তখনই সোশ্যাল মিডিয়ার একাংশ ব্যস্ত নাগরিক দুর্ভোগকে উপহাসের পাত্র করতে। এই প্রবণতা, যা Kolkata Floods Memes নামে পরিচিতি পাচ্ছে, তা সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিদদের কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। তাঁদের মতে, এটি শুধুমাত্র নির্মল মজা নয়, বরং এক গভীর সামাজিক অবক্ষয় এবং ক্রমবর্ধমান সহানুভূতির অভাবের প্রতিফলন।

এক নজরে মূল তথ্য

  • রেকর্ড বৃষ্টিপাত: আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ৪৮ ঘন্টায় শহরে প্রায় ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা গত এক দশকে সর্বোচ্চ। (সূত্র: দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫)
  • মানুষের মৃত্যু: কলকাতা পুলিশ এবং বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর রিপোর্ট অনুযায়ী, জলমগ্ন রাস্তায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এবং অন্যান্য দুর্ঘটনায় অন্তত ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। (সূত্র: রয়টার্স, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫)
  • মিমের বন্যা: শহরের এই ভয়াবহতার মাঝেই ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে “Kolkata Floods Memes” সম্পর্কিত পোস্টে প্রায় ১৫০% বৃদ্ধি দেখা গেছে বলে একটি ডিজিটাল অ্যানালিটিক্স সংস্থা জানিয়েছে।
  • বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ: মনোবিদরা এই প্রবণতাকে ‘গ্যালোস হিউমার’ (gallows humor) বা চরম পরিস্থিতিতে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে দেখলেও, এর মাত্রাধিক্যকে সামাজিক দূরত্বের ও সহানুভূতির অভাবের লক্ষণ বলেও চিহ্নিত করছেন।

যখন শহর ভাসে জলে

সোমবার রাত থেকে শুরু হওয়া প্রবল বৃষ্টি মঙ্গলবার সকালের মধ্যে কলকাতাকে কার্যত অচল করে দেয়। শহরের দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষত বেহালা, যাদবপুর, গড়িয়া এবং উত্তরের ঠনঠনিয়া, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এর বিস্তীর্ণ এলাকা কোমর-সমান জলের তলায়। কলকাতা পৌরসংস্থার বিপর্যয় মোকাবিলা দল এবং জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (NDRF) একযোগে উদ্ধারকার্যে নেমেছে।

পরিস্থিতির ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে কলকাতা পৌরসংস্থার এক আধিকারিক জানান, “আমাদের সমস্ত পাম্পিং স্টেশন ২৪ ঘন্টা চালানো হচ্ছে, কিন্তু বৃষ্টির পরিমাণ এত বেশি যে জল নামতে সময় লাগছে। আমাদের অগ্রাধিকার হলো আটকে পড়া মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরানো এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা।” (সূত্র: কলকাতা পৌরসংস্থা প্রেস রিলিজ, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫)

এই কঠিন বাস্তবতার ঠিক বিপরীত চিত্র সোশ্যাল মিডিয়ায়। জলমগ্ন রাস্তায় ভেসে যাওয়া গাড়ির ছবি দিয়ে তৈরি হয়েছে টাইটানিকের পোস্টার, কিংবা কোমর জলে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ছবি ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে ওয়ার্ক ফ্রম হোমের মজার মিম।

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ: কেন এই সংবেদনহীনতা?

এই ধরনের আচরণকে সহজ মজা বলে উড়িয়ে দিতে নারাজ বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এর পিছনে একাধিক মনস্তাত্ত্বিক এবং সমাজতাত্ত্বিক কারণ রয়েছে।

আত্মরক্ষার কৌশল না চূড়ান্ত উদাসীনতা?

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক ডঃ অনীক সেনগুপ্তের মতে, “দুর্যোগের সময় হাস্যরস বা মিম তৈরি করা এক ধরনের আত্মরক্ষার কৌশল হতে পারে, যা ‘কোপিং মেকানিজম’ (coping mechanism) নামে পরিচিত। যারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত নন, তারা অনেক সময়ই ঘটনার ভয়াবহতা থেকে নিজেদের মানসিকভাবে দূরে রাখতে এই পথ বেছে নেন। কিন্তু যখন এই রসিকতা ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি উপহাসে পরিণত হয়, তখন তা চরম উদাসীনতা এবং সহানুভূতির অভাবকেই প্রকট করে তোলে।” (বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে)।

মনোবিদরা বলছেন, ডিজিটাল পর্দার আড়ালে থাকার কারণে মানুষের মধ্যে এক ধরনের মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। অন্যের কষ্টকে তারা নিছকই একটি ‘কনটেন্ট’ হিসেবে দেখতে শুরু করে, যার সাথে ব্যক্তিগত আবেগ বা দায়বদ্ধতার কোনো যোগ থাকে না।

তথ্যের চেয়ে বিনোদনের প্রাধান্য

সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম এমনভাবেই তৈরি যে, যা কিছু বেশি আকর্ষণীয়, তাই বেশি প্রচারিত হয়। একটি মিম বা মজার ভিডিও যত দ্রুত শেয়ার হয়, বিপর্যয়ের সাহায্যের জন্য প্রয়োজনীয় ফোন নম্বর বা সতর্কবার্তার পোস্ট ততটা হয় না। এর ফলে, দুর্যোগের সময় সোশ্যাল মিডিয়া, যা তথ্য আদান-প্রদানের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারত, তা বিনোদনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, দুর্যোগের প্রথম ২৪ ঘন্টায় সাহায্যকারী পোস্টের চেয়ে মিম জাতীয় পোস্টের শেয়ারের হার প্রায় তিনগুণ বেশি ছিল। (সূত্র: ডিজিটাল মিডিয়া ওয়াচ, সেপ্টেম্বর ২০২৫ রিপোর্ট)

মানবিকতার অন্য ছবি: সাহায্যের হাতও বাড়ছে অনলাইনে

তবে মুদ্রার অপর পিঠও রয়েছে। এই মিমের বন্যার মধ্যেও একদল মানুষ সোশ্যাল মিডিয়াকেই ব্যবহার করছেন মানবিকতার স্বার্থে। বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ এবং হোয়াটসঅ্যাপে তৈরি হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক দল। তারা জলমগ্ন এলাকার মানুষের কাছে খাবার, পানীয় জল এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন।

“আমরা ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার পরিস্থিতি তুলে ধরছি এবং কোথায় কী ধরনের সাহায্য প্রয়োজন, তা সমন্বয় করার চেষ্টা করছি,”  “যখন দেখি কেউ আমাদের পোস্ট দেখে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছেন, তখন মনে হয় এখনও আশা আছে।” (একটি স্বেচ্ছাসেবী গোষ্ঠীর সদস্যের থেকে প্রাপ্ত তথ্য)

NDRF এবং কলকাতা পুলিশও তাদের অফিসিয়াল সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেল ব্যবহার করে ক্রমাগত সতর্কবার্তা এবংহেল্পলাইন নম্বর শেয়ার করছে, যা বহু মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে।

গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান ও তথ্য

১. বৃষ্টিপাতের পরিমাণ (সেপ্টেম্বর ২১-২৩, ২০২৫):

  • আলিপুর: ২৪৫ মিমি
  • দমদম: ২৩০ মিমি
  • সল্টলেক: ২১০ মিমি(সূত্র: আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর, [https://imdkolkata.gov.in/])

২. সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিটি (বিপর্যয়ের প্রথম ২৪ ঘন্টা):

  • মিম ও হিউমারাস পোস্ট শেয়ার: প্রায় ৫৫,০০০
  • সাহায্য ও তথ্যমূলক পোস্ট শেয়ার: প্রায় ১৮,০০০
  • নেতিবাচক ও সমালোচনামূলক পোস্ট: প্রায় ৮,০০০(সূত্র: একটি বেসরকারি ডিজিটাল অ্যানালিটিক্স সংস্থার প্রাথমিক সমীক্ষা)

৩. কলকাতা পৌরসংস্থার কন্ট্রোল রুম নম্বর:

  • জরুরী অবস্থার জন্য: 033-2286-1212 / 1313 / 1414
  • হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর: 8335999111(সূত্র: কলকাতা পৌরসংস্থা, [https://www.kmcgov.in/])

 ডিজিটাল নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব

প্রযুক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের হাতে enorme ক্ষমতা তুলে দিয়েছে। কিন্তু সেই ক্ষমতার ব্যবহার কীভাবে হবে, তার দায়িত্ব আমাদেরই। কলকাতার এই বিপর্যয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, ডিজিটাল মাধ্যমে আমাদের আচরণ বাস্তব জগতের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। একজন নাগরিকের মৃত্যু বা দুর্ভোগ যখন অন্যের হাসির খোরাক হয়, তখন বুঝতে হবে সমাজ হিসেবে আমরা এক গভীর সংকটের মুখোমুখি।

নির্মল রসিকতা এবং অন্যের বিপদ নিয়ে উপহাসের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সীমারেখা রয়েছে। ডিজিটাল নাগরিক হিসেবে সেই সীমারেখাটি চেনা এবং সম্মান করা আজ আগের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি। কারণ মানবিকতা এবং সহানুভূতি বাদ দিলে ডিজিটাল সমাজের জৌলুস অর্থহীন।

About Author
Avatar

আমাদের স্টাফ রিপোর্টারগণ সর্বদা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন যাতে আপনি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পেতে পারেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রতিশ্রুতি আমাদের ওয়েবসাইটকে একটি বিশ্বস্ত তথ্যের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।তারা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ে বিশ্বাসী, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন তৈরিতে সক্ষম