Kolkata Marble Place: 3 নির্মাণ করেছিলেন রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক, যিনি ছিলেন একজন ধনী বাঙালি ব্যবসায়ী এবং শিল্পপ্রেমী। নিওক্লাসিক্যাল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই প্রাসাদটি বর্তমানে একটি জাদুঘর হিসেবে পরিচিত, যেখানে রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত অসংখ্য মূল্যবান শিল্পকর্ম ও সাংস্কৃতিক নিদর্শন।
মার্বেল প্যালেসের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা ও সংগ্রহ দেখলে যে কেউ মুগ্ধ হবে। এখানে রয়েছে বিখ্যাত শিল্পীদের অসংখ্য মূল্যবান পেইন্টিং, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পিটার পল রুবেন্সের “দ্য ম্যারেজ অফ সেন্ট ক্যাথরিন” এবং “দ্য মার্টারডম অফ সেন্ট সেবাস্টিয়ান”, জোশুয়া রেনল্ডসের “দ্য ইনফ্যান্ট হারকিউলিস স্ট্র্যাঙ্গলিং দ্য সার্পেন্ট” ও “ভিনাস অ্যান্ড কিউপিড”। এছাড়াও রয়েছে টিশিয়ান, জন অপি, বার্টোলোমে এস্তেবান মুরিলো প্রমুখ শিল্পীদের অনেক কাজ। রাজা রবি বর্মার কিছু পেইন্টিংও এখানে প্রদর্শিত আছে।শিল্পকর্মের পাশাপাশি মার্বেল প্যালেসে রয়েছে অসংখ্য মূর্তি ও ভাস্কর্য। হোমার, ডায়ানা, ভিনাস, অ্যাপোলো, প্র্যাক্সিটেলিস, ফিডিয়াস, মোজেস প্রমুখ পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক চরিত্রের মূর্তি এখানে প্রদর্শিত। ভিক্টোরিয়ান আমলের আসবাবপত্র, ঝাড়বাতি, ঘড়ি, দেয়াল-থেকে-মেঝে পর্যন্ত আয়না, পাত্র ও রাজকীয় মূর্তি দিয়ে সাজানো হয়েছে প্রাসাদের বিভিন্ন কক্ষ।
জলের নীচে অপরূপ সৌন্দর্য, স্কুবা ডাইভিংয়ের সেরা গন্তব্যগুলি
মার্বেল প্যালেসের স্থাপত্য নকশায় নিওক্লাসিক্যাল শৈলীর সাথে বাংলার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের সমন্বয় ঘটেছে। তিনতলা এই প্রাসাদের বাইরের দিকে রয়েছে উঁচু করিন্থীয় স্তম্ভ এবং অলংকৃত বারান্দা। ছাদের ঢালু অংশে রয়েছে জালের মতো কারুকাজ। চীনা প্যাভিলিয়নের আদলে নির্মিত এই প্রাসাদের অভ্যন্তরে রয়েছে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ, যা বাংলার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য। প্রাঙ্গণের পাশেই রয়েছে ঠাকুরদালান, যেখানে মল্লিক পরিবারের দেবদেবীর পূজা হয়।মার্বেল প্যালেসের চারপাশে রয়েছে বিশাল বাগান, যেখানে আছে একটি হ্রদ, রক গার্ডেন এবং একটি ছোট চিড়িয়াখানা। এই চিড়িয়াখানাটি ভারতের প্রথম ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা হিসেবে পরিচিত। রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক উদ্ভিদবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন এবং তিনি নানা প্রজাতির পাখি ও প্রাণী সংগ্রহ করেছিলেন। বর্তমানে চিড়িয়াখানায় হরিণ, ময়ূর, বানর প্রভৃতি প্রাণী রয়েছে।
মার্বেল প্যালেসের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এর সংগ্রহশালা। ১৮৩০ সালে ইতালি ও বেলজিয়াম থেকে আনা ৭৬টি দুর্লভ শিল্পকর্ম এখানে রয়েছে। প্রবেশপথে রয়েছে একটি বিশাল জাপানি ব্রোঞ্জের পাত্র। দেয়ালে লাগানো বেলজিয়ামের পূর্ণদৈর্ঘ্য আয়নাগুলো অতিরিক্ত স্থানের ভ্রম সৃষ্টি করে। বাগানের মাঝখানে রয়েছে একটি মার্বেলের ফোয়ারা যেখানে স্থাপিত আছে বিখ্যাত “লেডা অ্যান্ড দ্য সোয়ান” ভাস্কর্য।মার্বেল প্যালেসের সংগ্রহ এতটাই বিশাল ও বৈচিত্র্যময় যে কখনও কখনও তা একটু এলোমেলো মনে হতে পারে। মূল্যবান শিল্পকর্মের পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের ভিক্টোরিয়ান যুগের খুচরা জিনিসপত্রও এখানে প্রদর্শিত।
কিন্তু এই বৈচিত্র্যই মার্বেল প্যালেসকে অনন্য করে তুলেছে।মার্বেল প্যালেস শুধু একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ নয়, এটি একটি জীবন্ত ঐতিহ্যের প্রতীক। রাজা রাজেন্দ্র মল্লিকের বংশধররা এখনও এই প্রাসাদে বসবাস করেন। তারা রাজা রাজেন্দ্র মল্লিকের শুরু করা একটি মহৎ ঐতিহ্য অব্যাহত রেখেছেন – প্রতিদিন দুপুরে প্রাসাদের বাইরে ৫০০ জন দরিদ্র মানুষকে খাবার দেওয়া হয়, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে।মার্বেল প্যালেস দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত, তবে ফটোগ্রাফি নিষিদ্ধ। প্রবেশের জন্য পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দপ্তর থেকে অনুমতি নিতে হয়। সোমবার ও বৃহস্পতিবার ছাড়া সপ্তাহের অন্য দিনগুলিতে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত প্রাসাদ পরিদর্শন করা যায়।
মার্বেল প্যালেস কলকাতার একটি অমূল্য ঐতিহ্য। ১২৬ প্রকারের মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত এই প্রাসাদ শুধু তার স্থাপত্যের জন্যই নয়, এর অসাধারণ শিল্প ও সাংস্কৃতিক সংগ্রহের জন্যও বিখ্যাত। এটি ১৯শ শতকের কলকাতার সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের একটি জীবন্ত প্রমাণ। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এটি শুধু একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ নয়, বরং একটি জীবন্ত শিক্ষাকেন্দ্র যেখানে তারা ইতিহাস, শিল্প ও সংস্কৃতির সমন্বয় দেখতে পায়।