কলকাতার পরিবহণ ব্যবস্থায় এবার নতুন বিপ্লব। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আগামী ২২ অগাস্ট থেকে চালু হচ্ছে হাওড়া ময়দান থেকে সল্টলেক সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত সরাসরি মেট্রো পরিষেবা। এতদিন যে পথ অতিক্রম করতে যাত্রীদের দেড় ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হত, এবার সেই ১৬.৫ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে লাগবে মাত্র ৩০ থেকে ৩২ মিনিট।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যশোর রোড থেকে পতাকা নেড়ে এই ঐতিহাসিক মেট্রো পরিষেবার আনুষ্ঠানিক সূচনা করবেন। এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ হবে ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্প, যা কলকাতার পরিবহণ ব্যবস্থায় এনে দেবে এক নতুন মাত্রা।
এই নতুন রুট চালুর ফলে সরাসরি জুড়ে যাবে সাবার্বান লাইনের দুই প্রধান টার্মিনাল হাওড়া ও শিয়ালদহ। বিশেষভাবে উপকৃত হবেন জেলা শহর থেকে আসা যাত্রী ও দৈনিক অফিসযাত্রীরা। হাওড়া থেকে শিয়ালদহ পৌঁছতে এখন সড়কপথে আধ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে, যানজট ও বিশেষ পরিস্থিতিতে যা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত বেড়ে যায়। কিন্তু মেট্রোতে এই দূরত্ব অতিক্রম করতে লাগবে মাত্র ১১ থেকে ১২ মিনিট।
হাওড়া থেকে সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত মেট্রো ভাড়া হবে মাত্র ২৫ টাকা, যা অন্যান্য পরিবহণ মাধ্যমের তুলনায় অনেক সাশ্রয়ী। এই পরিষেবা চালুর ফলে সল্টলেক সেক্টর ফাইভে কর্মরত আইটি পেশাদার ও কর্পোরেট কর্মীদের যাতায়াত হবে অত্যন্ত সহজ ও দ্রুততর।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, হুগলির দিক থেকে মেইন লাইন ও কর্ড লাইনে আসা যাত্রীরা এতদিন বালি স্টেশনে নেমে ট্রেন বদলে বিধাননগর রোড হয়ে অটো বা বাসে করে সেক্টর ফাইভ পৌঁছাতেন। এই জটিল প্রক্রিয়ায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লেগে যেত। নতুন মেট্রো পরিষেবার ফলে এই যাত্রীরা হাওড়া থেকে মাত্র ৩৫ মিনিটেই পৌঁছে যেতে পারবেন তাদের গন্তব্যে।
কলকাতা মেট্রোর এই ইস্ট ওয়েস্ট প্রকল্পের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ ও জটিল। ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই প্রায় ১৭ কিলোমিটার মেট্রো লাইনের সম্পূর্ণ বাস্তবায়নে সময় লেগেছে পুরো ১৭ বছর। তবে এই প্রকল্পের প্রাথমিক ধারণা আরও পুরনো। ১৯২১ সালে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার স্যার হার্লে হিউ ডার্লিম্পল-হে প্রথম হাওড়া থেকে শিয়ালদহ হয়ে একটি ভূগর্ভস্থ রেলওয়ে লাইনের পরিকল্পনা করেন। লন্ডন টিউবের আদলে পরিকল্পিত এই প্রকল্প কলকাতার নরম মাটির কারণে বাতিল করতে হয়েছিল।
পরবর্তীতে বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ও এই ধরনের পরিকল্পনা করেছিলেন। প্রায় ১০৪ বছর পর অবশেষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটতে চলেছে। গঙ্গার নীচ দিয়ে মেট্রো চালানোর এই দুঃসাধ্য কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে।
সল্টলেক সেক্টর ফাইভ থেকে হাওড়া ময়দান পর্যন্ত ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্প এতদিন দুটি ভাগে চালু ছিল। প্রথমে চালু হয় সল্টলেক সেক্টর ফাইভ থেকে শিয়ালদহ স্টেশন (গ্রিন লাইন ওয়ান) পর্যন্ত অংশ। গত বছর থেকে হাওড়া ময়দান থেকে এসপ্ল্যানেড (গ্রিন লাইন টু) পর্যন্ত মেট্রো পরিষেবা চালু হয়। এখন শিয়ালদহ থেকে এসপ্ল্যানেড অংশ জুড়ে দিয়ে সম্পূর্ণ হলো এই গুরুত্বপূর্ণ করিডর।
শিয়ালদহ থেকে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত মেট্রোর কাজে বারবার বিঘ্ন ঘটেছিল অতীতে। বিশেষ করে বৌবাজার এলাকায় ধসের কারণে কলকাতা মেট্রোরেল কর্পোরেশন লিমিটেডকে নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছিল। এবার সেই বাধা অতিক্রম করে সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে এই অংশের কাজ।
বর্তমানে ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোতে প্রতিদিন গড়ে এক লক্ষ যাত্রী যাতায়াত করেন। পরিষেবা পুরোদমে চালু হয়ে গেলে দৈনিক যাত্রীসংখ্যা সাত লক্ষ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে অনুমান কলকাতা মেট্রোর জেনারেল ম্যানেজার পি উদয়কুমার রেড্ডির। এই বৃদ্ধির প্রত্যাশায় ইতিমধ্যেই প্রতিটি স্টেশনে কর্মীসংখ্যা বাড়ানোর কাজ শুরু হয়েছে।
পরিষেবার ফ্রিকোয়েন্সির ক্ষেত্রেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। বর্তমানে দিনের ব্যস্ত সময়ে সেক্টর ফাইভ-শিয়ালদহ এবং হাওড়া ময়দান-এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত ১২ মিনিট অন্তর মেট্রো পরিষেবা পাওয়া যায়। ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো পুরোদমে চালু হয়ে গেলে দিনের ব্যস্ত সময়ে আট মিনিট অন্তর পরিষেবা পাওয়া যাবে। অন্য সময়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট অন্তর মেট্রো চলবে।
এই নতুন পরিষেবা চালু হলে কলকাতার দুটি প্রধান অফিসপাড়াও বিশেষভাবে উপকৃত হবে। এসপ্ল্যানেড চত্বরের অফিসপাড়ায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে এতদিন শুধু হাওড়া স্টেশন থেকেই মেট্রোর সুবিধা পাওয়া যেত। এখন শিয়ালদহ স্টেশন থেকেও সেই সুবিধা মিলবে। পাশাপাশি হাওড়া থেকে সরাসরি মেট্রোয় চেপে পৌঁছে যাওয়া যাবে কলকাতার তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র সল্টলেক সেক্টর ফাইভে।
হাওড়া স্টেশন থেকে কলকাতা বিমানবন্দরে যাতায়াতের ক্ষেত্রেও নতুন সুবিধা মিলবে। এতদিন বাস বা ট্যাক্সি পরিষেবার ওপর নির্ভর করতে হলেও এখন এক টিকিটেই মেট্রোয় চেপে হাওড়া ময়দান থেকে পৌঁছে যাওয়া যাবে দমদম বিমানবন্দরে। যদিও মাঝে দুবার মেট্রো বদল করতে হবে। তবে বারবার টিকিট কাটতে হবে না, সব রুটে চলবে একই স্মার্টকার্ড।
এই মেট্রো পরিষেবা কলকাতার যানজট নিরসনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যারা নিজের গাড়ি বা বাইক নিয়ে যাতায়াত করেন, তাদের অনেকেই ক্রমবর্ধমান জ্বালানি খরচের কারণে মেট্রোর মতো দ্রুত গণপরিবহণের দিকে ঝুঁকবেন। এর ফলে কমবে রাস্তায় যানজট এবং বায়ু দূষণও।
যাত্রীদের কাছে একমাত্র চিন্তার বিষয় হচ্ছে কিউআর কোড যুক্ত কাগজের টিকিট। এই টিকিটে গেটে প্রায়ই সমস্যা হয়, কাগজ ভাঁজ হয়ে গেলে বা স্ক্যানারে আটকে গেলে লম্বা লাইন তৈরি হয়। অনেকেই দাবি জানিয়েছেন পুনরায় টোকেন চালু করার, যাতে যাত্রী চলাচল আরও সহজ হয়।
সামগ্রিকভাবে হাওড়া-সেক্টর ফাইভ মেট্রো পরিষেবা চালু হলে শুধু কলকাতার ট্রাফিক চাপই কমবে না, বদলে যাবে শহরের দৈনন্দিন ছন্দও। জেলার মানুষ থেকে অফিসযাত্রী সবাই পাবেন দ্রুত ও সাশ্রয়ী যাতায়াতের সুবিধা। এক কথায় পূর্ব-পশ্চিম মেট্রো হয়ে উঠবে কলকাতার নতুন জীবনরেখা। দীর্ঘ ১০৪ বছরের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে কলকাতার পরিবহণ ইতিহাসে রচিত হতে চলেছে এক নতুন অধ্যায়।