জলমগ্ন শহরে মৃত্যুর মিছিল, শোকের আবহে ভার্চুয়াল পুজো উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী, উঠছে সংবেদনশীলতার প্রশ্ন

পুজোর মুখে প্রকৃতির রুদ্ররোষে কার্যত স্তব্ধ কলকাতা। সোমবার রাতভর চলা রেকর্ডভাঙা বৃষ্টিতে ভাসছে শহর, আর সেই জমা জলেই মৃত্যুর কালো ছায়া। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অন্তত ৮ জন নাগরিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায়…

Avatar

 

পুজোর মুখে প্রকৃতির রুদ্ররোষে কার্যত স্তব্ধ কলকাতা। সোমবার রাতভর চলা রেকর্ডভাঙা বৃষ্টিতে ভাসছে শহর, আর সেই জমা জলেই মৃত্যুর কালো ছায়া। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অন্তত ৮ জন নাগরিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় উৎসবের আবহে নেমে এসেছে গভীর শোক। এই বিপর্যয়ের আবহে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কলকাতার সমস্ত পুজো উদ্বোধনের কর্মসূচি বাতিল করে জেলার পুজো মণ্ডপগুলির উদ্বোধন সারলেন ভার্চুয়াল মাধ্যমে। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়েছে আলোচনা ও রাজনৈতিক বিতর্ক।

নজিরবিহীন এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং তার পরবর্তী প্রশাসনিক পদক্ষেপ, বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রীর ভার্চুয়াল পুজো উদ্বোধন (virtual puja inauguration) নিয়ে বিভিন্ন মহলে উঠছে প্রশ্ন। একদিকে যখন শহরবাসী নজিরবিহীন জলযন্ত্রণা এবং আপনজন হারানোর শোকে মুহ্যমান, তখন অন্যদিকে ডিজিট্যাল মাধ্যমে উৎসবের সূচনা কতটা সংবেদনশীল, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। যদিও শাসকদলের তরফে জানানো হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী পরিস্থিতির দিকে অনবরত নজর রাখছেন এবং বিপর্যয় মোকাবিলায় সমস্ত রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

মূল তথ্য / এক নজরে

  • রেকর্ড বৃষ্টিপাত: আবহাওয়া দফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় কলকাতায় ২৫০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর ফলে শহরের অধিকাংশ রাস্তা ও নিচু এলাকা জলের তলায়।
  • মর্মান্তিক পরিণতি: কলকাতা পুলিশের সূত্র অনুযায়ী, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অন্তত ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। জমা জলে ছিঁড়ে পড়ে থাকা তার বা ল্যাম্পপোস্ট থেকে এই দুর্ঘটনাগুলি ঘটেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে অনুমান।
  • মুখ্যমন্ত্রীর পদক্ষেপ: উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় তাঁর সমস্ত भौतिक পুজো উদ্বোধনের কর্মসূচি বাতিল করেন। পরিবর্তে, তিনি কালীঘাটের বাসভবন থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে প্রায় শতাধিক জেলাভিত্তিক পুজোর উদ্বোধন করেন।
  • শাসক-বিরোধী তরজা: সরকারের ভূমিকা এবং মুখ্যমন্ত্রীর ভার্চুয়াল উদ্বোধন নিয়ে তীব্র কটাক্ষ করেছে বিরোধী দল বিজেপি। তাদের মতে, এটি প্রশাসনের ব্যর্থতা ঢাকার এবং মানুষের যন্ত্রণা থেকে নজর ঘোরানোর একটি প্রয়াস

নজিরবিহীন বৃষ্টি এবং শহরের হাহাকার

সোমবার রাত থেকে শুরু হওয়া প্রবল বৃষ্টি মঙ্গলবার সকালের মধ্যে কলকাতাকে এক জলমগ্ন নগরীতে পরিণত করে। শহরের প্রধান ধমনী থেকে শুরু করে অলিগলি— সর্বত্র কোমর সমান জল। এর ফলে পরিবহন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। মেট্রো রেলের একাংশ এবং চক্ররেল পরিষেবা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। বহু ফ্লাইট বাতিল করা হয় এবং দূরপাল্লার ট্রেন চলাচলও ব্যাহত হয়।

পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরে আলিপুর আবহাওয়া দফতরের এক আধিকারিক জানান, “একটি নিম্নচাপ অক্ষরেখার প্রভাবে এই বিপুল পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টাতেও ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।”

শহরের এই জলযন্ত্রণা চরমে পৌঁছায় একাধিক মৃত্যুর খবরে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদন অনুসারে, মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত বেহালা, হরিদেবপুর, মোমিনপুর, এবং কসবা এলাকা থেকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর খবর আসে। এই ঘটনাগুলি শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং পরিকাঠামোর নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

পরিসংখ্যান চিত্রে কলকাতা বিপর্যয় (২৩শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫)

সূচক পরিসংখ্যান উৎস
বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২৫১.৪ মিমি (২৪ ঘণ্টায়) আলিপুর আবহাওয়া দফতর
মৃতের সংখ্যা (সরকারি) ৮ জন (বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে) কলকাতা পুলিশ ও সরকারি প্রেস রিলিজ
বিমান বাতিল ৩০টির বেশি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ
স্কুল-কলেজ বন্ধ ২ দিনের জন্য ছুটি ঘোষণা পশ্চিমবঙ্গ সরকার

প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়া ও মুখ্যমন্ত্রীর ভার্চুয়াল উদ্বোধন

এই বিপর্যয়ের মাঝে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিনের শুরুতেই কলকাতায় তাঁর সমস্ত পুজো উদ্বোধনের কর্মসূচি বাতিলের কথা ঘোষণা করেন। তিনি নবান্নে একটি কন্ট্রোল রুম খোলার নির্দেশ দেন এবং নিজে পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন।

এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি এই মৃত্যুকে “অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক” বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন,

“আমি এমন বৃষ্টি আগে কখনও দেখিনি। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ৭-৮ জনের মৃত্যু খুবই দুঃখজনক। আমি পরিষ্কার বলছি, CESC-কে মৃতদের পরিবারের একজনকে চাকরি দিতে হবে। আমরাও যতটা সম্ভব সাহায্য করব। বিদ্যুৎ সরবরাহ CESC করে, আমরা নই। তাদের পরিকাঠামো আরও আধুনিক করা উচিত।”

তিনি এই বিপর্যয়ের জন্য ফারাক্কা বাঁধের অপর্যাপ্ত ড্রেজিংকেও দায়ী করেন। তবে দিনের শেষে, তিনি তাঁর বাসভবন থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে পূর্ব নির্ধারিত জেলাগুলির পুজো উদ্বোধন করেন। এই সময় তিনি পুজো উদ্যোক্তাদের সমস্ত রকম সতর্কতা অবলম্বন করার এবং মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।

 বিরোধীদের মতামত

মুখ্যমন্ত্রীর এই ভার্চুয়াল উদ্বোধন নিয়ে রাজনৈতিক এবং নাগরিক সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী রাজ্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বলেন,

“এক রাতের বৃষ্টিতেই কলকাতা-সল্টলেক জলের তলায়! নগরবাসীর দুর্দশার জন্য কলকাতা ও বিধাননগর পুরনিগমের মেয়রদের অদক্ষতা এবং উদাসীনতাই দায়ী। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এতগুলো নিরীহ প্রাণ চলে গেল। এটা শুধু ব্যর্থতা নয়, এটা অপরাধ।”

বিরোধী শিবিরের মতে, যখন শহর শোকে আচ্ছন্ন এবং উদ্ধারकार्यই মূল অগ্রাধিকার হওয়া উচিত, তখন উৎসবের উদ্বোধন করাটা একপ্রকার সংবেদনহীনতার পরিচয়।

অন্যদিকে, রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিমল শংকর রায়ের মতে, “মুখ্যমন্ত্রী একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছেন। একদিকে প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে তাঁকে বিপর্যয় মোকাবিলা করতে হচ্ছে, অন্যদিকে উৎসবের মরসুমে রাজ্যের মানুষকে বার্তা দেওয়ার দায়ও তাঁর রয়েছে। ভার্চুয়াল উদ্বোধনের মাধ্যমে তিনি হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন যে জীবন থেমে থাকবে না, তবে সশরীরে উপস্থিত না থেকে তিনি বিপর্যয়ের গুরুত্বকেও স্বীকার করেছেন।”

সাধারণ মানুষের উপর প্রভাব

এই আকস্মিক বিপর্যয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। দক্ষিণ কলকাতার এক বাসিন্দা, শ্রীমতী অনিতা দাস বলেন, “আমাদের একতলার বাড়ি পুরো জলের তলায়। বিদ্যুৎ নেই, পানীয় জল নেই। এর মধ্যে শুনছি মৃত্যুর খবর। পুজোর সব আনন্দ মাটি হয়ে গেল।”

এই ঘটনায় মৃত এক ফল বিক্রেতার পরিবারে নেমে এসেছে অন্ধকার। তাঁর প্রতিবেশী জানান, “ভোরে সাইকেল নিয়ে বাজারে যাওয়ার সময় ল্যাম্পপোস্টে হাত দিতেই সব শেষ হয়ে যায়। বাড়িতে তাঁর বৃদ্ধা মা ও ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আছে।” এই ধরনের মর্মান্তিক কাহিনী শহরের বাতাসে এক ভারী শোকের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে।

পরবর্তী পদক্ষেপ

প্রশাসনের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল দ্রুত জল নামিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা এবং বিদ্যুৎ সংযোগ সুরক্ষিত করা। CESC-এর তরফে জানানো হয়েছে যে তারা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছে এবং বিপজ্জনক এলাকাগুলিতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছে।

এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করল যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সামনে কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো কতটা ভঙ্গুর। পুজো আসছে, কিন্তু তার আগে শহরবাসীর মনে এখন শুধুই জলযন্ত্রণা এবং প্রিয়জন হারানোর আতঙ্ক। মুখ্যমন্ত্রীর ভার্চুয়াল উদ্বোধন একাধারে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং এই কঠিন সময়ে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, যার রেশ হয়তো উৎসবের দিনগুলিতেও থেকে যাবে।

About Author
Avatar

আমাদের স্টাফ রিপোর্টারগণ সর্বদা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন যাতে আপনি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পেতে পারেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রতিশ্রুতি আমাদের ওয়েবসাইটকে একটি বিশ্বস্ত তথ্যের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।তারা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ে বিশ্বাসী, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন তৈরিতে সক্ষম