শুধু বৃষ্টিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই! কলকাতার জল জমার পেছনে আসল কারণ কী?

 গত রাতের কয়েক ঘণ্টার প্রবল বৃষ্টিতে আবারও জলের তলায় চলে গেল কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। উত্তর থেকে দক্ষিণ, শহরের মূল রাস্তা থেকে অলিগলি— সর্বত্রই থমকে গিয়েছে জনজীবন। এই পরিস্থিতি নতুন নয়,…

Avatar

 

 গত রাতের কয়েক ঘণ্টার প্রবল বৃষ্টিতে আবারও জলের তলায় চলে গেল কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। উত্তর থেকে দক্ষিণ, শহরের মূল রাস্তা থেকে অলিগলি— সর্বত্রই থমকে গিয়েছে জনজীবন। এই পরিস্থিতি নতুন নয়, প্রতি বর্ষাতেই কলকাতাবাসীকে এই দুর্ভোগ পোহাতে হয়। প্রশ্ন উঠছে, আধুনিক এই মহানগরীর প্রতি বছরের এই জলবন্দি দশার জন্য দায়ী কে? শুধুমাত্র কলকাতা পুরসভার (KMC) পরিকাঠামোগত দুর্বলতা, নাকি আমাদের, অর্থাৎ নাগরিকদের চূড়ান্ত উদাসীনতাও এই Kolkata Waterlogging সমস্যার জন্য সমানভাবে দায়ী? এই প্রতিবেদনে আমরা প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং নাগরিক দায়িত্বহীনতা— উভয় দিকই তথ্য ও বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

এক নজরে: জল-যন্ত্রণার আসল কারণ

  • বিপর্যয়কর বৃষ্টিপাত: গত ২৪ ঘণ্টায় শহরের একাধিক জায়গায়, বিশেষত দক্ষিণ ও পূর্ব কলকাতায় ৩০০ মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা শহরের নিকাশি ব্যবস্থার স্বাভাবিক ক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
  • প্লাস্টিকের প্রাচীর: বিশেষজ্ঞদের মতে, শহরের নিকাশি ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হল প্লাস্টিক ও কঠিন বর্জ্য। প্রতিদিন কলকাতায় উৎপন্ন প্রায় ৪০০০ মেট্রিক টন বর্জ্যের একটা বড় অংশই প্লাস্টিক, যা সরাসরি নর্দমা ও গালিপিটে গিয়ে জলপ্রবাহ আটকে দেয়।
    পুরনো পরিকাঠামো: কলকাতা পুরসভার অধীনস্থ প্রায় ৪০-৫০% নিকাশি নালা এবং মূল ড্রেনেজ লাইন ব্রিটিশ আমলে তৈরি, যা বর্তমানের জনসংখ্যার চাপ এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের সঙ্গে তাল মেলাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
  • জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি: জলমগ্নতার কারণে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, লেপটোস্পাইরোসিসের মতো জলবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে। চিকিৎসকদের মতে, প্রতি বর্ষায় এই ধরণের রোগের সংক্রমণ ১০-১৫% বৃদ্ধি পায়।
  • সমন্বয়ের অভাব: পুরসভা, সেচ দপ্তর এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব প্রায়শই খাল সংস্কার এবং নিকাশি ব্যবস্থাপনার কাজকে ব্যাহত করে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।

 প্রতি বর্ষার চেনা ছবি

সোমবার রাত থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি মঙ্গলবার সকালেও শহরকে রেহাই দেয়নি। ঠনঠনিয়া থেকে বেহালা, কসবা থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ— সর্বত্রই জল জমে যাওয়ায় চূড়ান্ত ভোগান্তির শিকার সাধারণ মানুষ। বহু জায়গায় একতলা বাড়িতে জল ঢুকে গিয়েছে, রাস্তায় আটকে পড়েছে যানবাহন, ব্যাহত হয়েছে মেট্রো পরিষেবাও। এই ঘটনা আবারও শহরের নিকাশি পরিকাঠামোর কঙ্কালসার চেহারাটা প্রকাশ্যে এনেছে। কিন্তু গভীরে গেলে বোঝা যায়, সমস্যাটা কেবল পরিকাঠামোর নয়, মানসিকতারও। যে শহরের নাগরিকরা জেনে বুঝেও প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ নর্দমায় ফেলেন, নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে নিকাশি পথ আটকে দেন, তাদের দায়ও কিছু কম নয়। এই Kolkata Waterlogging সমস্যাটি প্রশাসন এবং নাগরিকের যৌথ ব্যর্থতার এক নিদারুণ প্রতিচ্ছবি।

প্রশাসনিক পরিকাঠামো এবং তার সীমাবদ্ধতা

কলকাতা পুরসভা প্রতি বছর বর্ষার আগে নিকাশি সাফাই এবং পাম্পিং স্টেশন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করার দাবি করে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি সেই দাবির সঙ্গে মেলে না। এর পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ।

 ব্রিটিশ আমলের নিকাশি ব্যবস্থা ও বর্তমানের চাপ

কলকাতার মূল নিকাশি ব্যবস্থা প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো। তৎকালীন জনসংখ্যার কথা মাথায় রেখে এটি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক দশকে শহরের জনসংখ্যা এবং জনঘনত্ব বহুগুণ বেড়েছে। বেআইনি নির্মাণ, জলাভূমি ভরাট করে আবাসন তৈরি এবং কংক্রিটের জঙ্গল মাটির জলধারণ ক্ষমতা প্রায় শেষ করে দিয়েছে। ফলে বৃষ্টির জল মাটির নীচে যাওয়ার বদলে সরাসরি রাস্তার উপর চাপ সৃষ্টি করে, যা পুরনো নিকাশি ব্যবস্থা সামাল দিতে পারে না।

পাম্পিং স্টেশন: ক্ষমতার চেয়ে চাহিদা বেশি

কলকাতা পুরসভার অধীনে প্রায় ৮০টি ড্রেনেজ পাম্পিং স্টেশন রয়েছে। পুরসভার আধিকারিকদের মতে, এই পাম্পিং স্টেশনগুলির সম্মিলিত ক্ষমতা ঘণ্টায় প্রায় ৬-৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের জল নিকাশ করার। কিন্তু গত রাতের মতো যখন কয়েক ঘণ্টায় ১০০-১৫০ মিলিমিটার বা তার বেশি বৃষ্টি হয়, তখন এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে বাধ্য। যদিও পুরসভা দাবি করে যে তারা তাদের ক্ষমতা দ্বিগুণ করেছে, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি প্রমাণ করে যে তা এখনও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

 খাল দখল এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন

একসময় কলকাতাকে ঘিরে থাকা একাধিক খাল এবং জলাভূমি প্রাকৃতিক নিকাশি ব্যবস্থার কাজ করত। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে সেই খালগুলির অধিকাংশই আজ বেদখল বা আবর্জনায় ভর্তি। ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ডস, যা শহরের প্রাকৃতিক ড্রেনেজ হিসাবে কাজ করে, তার চরিত্র বদলের ফলেও জল জমার সমস্যা বেড়েছে। প্রশাসনিক স্তরে এই দখলদারি রুখতে কঠোর পদক্ষেপের অভাব স্পষ্ট।

নাগরিক উদাসীনতা: সমস্যার অপর পিঠ

প্রশাসনের দিকে আঙুল তোলা সহজ, কিন্তু আয়নায় নিজেদের মুখ দেখতে আমরা প্রায়শই ভুলে যাই। কলকাতার জল জমার সমস্যার পেছনে আমাদের চূড়ান্ত নাগরিক দায়িত্বহীনতা এক বিরাট কারণ।

প্লাস্টিক এবং কঠিন বর্জ্যের ভূমিকা

একবার ভাবুন তো, চিপসের প্যাকেট, জলের বোতল বা প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগটা আপনি কোথায় ফেলেন? ডাস্টবিনে নাকি রাস্তার পাশের নর্দমায়? একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, কলকাতায় প্রতিদিন যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, তার একটা বড় অংশই গালিপিট এবং নর্দমার মুখ বন্ধ করে দেয়।

 বর্জ্যের ভয়াবহতা

একটি সমীক্ষা অনুসারে, কলকাতা প্রতিদিন প্রায় ৪,০০০ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন করে। এর মধ্যে প্রায় ৩৫% প্লাস্টিক, যার ৭০% হল একবার ব্যবহারযোগ্য পাতলা পলিথিন ব্যাগ। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক নিকাশি ব্যবস্থাকে কার্যত অকেজো করে দিচ্ছে।

যখন ভারী বৃষ্টি হয়, তখন এই প্লাস্টিকগুলি জলের তোড়ে ভূগর্ভস্থ নিকাশি ব্যবস্থার মুখে গিয়ে জমা হয় এবং একটি অদৃশ্য বাঁধ তৈরি করে। ফলে পাম্পিং স্টেশন চালু থাকলেও জল নামতে পারে না।

 বেআইনি নির্মাণ ও যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা

শুধু প্লাস্টিক নয়, বাড়ি বা ফ্ল্যাট তৈরির সময় নির্মাণ সামগ্রী (বালি, সিমেন্ট, ইট) রাস্তার উপর ফেলে রাখা হয়, যা নিকাশি নালাগুলিকে বন্ধ করে দেয়। পুরসভার নিয়ম থাকলেও তার তোয়াক্কা করার প্রয়োজন বোধ করেন না অনেকেই। এর পাশাপাশি, পুরনো আসবাব থেকে শুরু করে বিছানা-বালিশ পর্যন্ত খালে বা নর্দমায় ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনাও বিরল নয়।

আধিকারিক এবং বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য

এই জটিল পরিস্থিতি নিয়ে কলকাতা পুরসভার এক আধিকারিক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, “আমরা আমাদের সমস্ত পাম্পিং স্টেশন রাতভর চালিয়েছি। কিন্তু প্লাস্টিক এবং আবর্জনা যেভাবে নর্দমার মুখ বন্ধ করে রেখেছে, তাতে জল নামানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। আমরা খাল সংস্কারের কাজ করছি, কিন্তু নাগরিক সচেতনতা ছাড়া এই যুদ্ধ জেতা সম্ভব নয়।” (সূত্র: স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য)।

অন্যদিকে, নগর পরিকল্পনাবিদ ডঃ অরিন্দম ঘোষের মতে, “এটা একটা সামগ্রিক ব্যর্থতা। শুধু পাম্পিং স্টেশনের সংখ্যা বাড়ালে হবে না। আমাদের একটি ইন্টিগ্রেটেড আরবান ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট পলিসি দরকার। এর মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাভূমি সংরক্ষণ এবং নাগরিকদের জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ—সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কলকাতাকে স্পঞ্জের মতো হতে হবে, কংক্রিটের মতো নয়।” (বিশেষজ্ঞ মত, বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে সংগৃহীত)।

জনজীবনের উপর প্রভাব ও ভবিষ্যতের পথ

জলমগ্নতার ফলে শুধু যাতায়াতের সমস্যাই হয় না, এর অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাবও মারাত্মক। দোকান-বাজার বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীদের বিপুল ক্ষতি হয়। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর মতো মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটে। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে দ্বিমুখী পদক্ষেপ প্রয়োজন।

  1. প্রশাসনিক স্তরে:

    • পুরনো নিকাশি ব্যবস্থার সংস্কার এবং আধুনিকীকরণ।
    • খাল দখলমুক্ত করতে কঠোর রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ।
    • বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আরও কার্যকর করা এবং প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণে আইনের কঠোর প্রয়োগ।
  2. নাগরিক স্তরে:

    • যত্রতত্র আবর্জনা, বিশেষ করে প্লাস্টিক ফেলা বন্ধ করা।
    • বর্জ্য পৃথকীকরণে (Waste Segregation) সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া।
    • অন্যদেরও এই বিষয়ে সচেতন করা।

কলকাতার জল জমার সমস্যাটি একটি দুষ্টচক্রের মতো, যেখানে প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং নাগরিক উদাসীনতা একে অপরকে ইন্ধন জোগায়। পুরসভা পরিকাঠামোর দোহাই দিয়ে নিজের দায় এড়াতে চায়, আর নাগরিকরা সব দোষ প্রশাসনের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেদের দায়িত্ব ভুলে যান। এই পারস্পরিক দোষারোপের খেলা বন্ধ না হলে প্রতি বর্ষায় আমাদের জলবন্দি হয়েই থাকতে হবে। কলকাতাকে বাঁচাতে হলে প্রশাসন এবং নাগরিক—উভয়কেই নিজেদের দায়িত্ব স্বীকার করে একযোগে কাজ করতে হবে। পরিকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি মানসিকতার পরিবর্তনই হতে পারে এই জল-যন্ত্রণা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ।

 

About Author
Avatar

আমাদের স্টাফ রিপোর্টারগণ সর্বদা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন যাতে আপনি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পেতে পারেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রতিশ্রুতি আমাদের ওয়েবসাইটকে একটি বিশ্বস্ত তথ্যের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।তারা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ে বিশ্বাসী, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন তৈরিতে সক্ষম