Largest Ship of World: মানুষের অদম্য জিজ্ঞাসা ও প্রযুক্তিগত উন্নতি সমুদ্রপথে যাতায়াতের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। বিশাল জাহাজগুলো শুধু পরিবহন মাধ্যমই নয়, মানব সভ্যতার অগ্রগতির প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হয়। এই প্রতিবেদনে আমরা বিশ্বের দীর্ঘতম জাহাজের উত্থান, পুনর্জন্ম এবং পতনের গল্প তুলে ধরব।
১৯১২ সালে নির্মিত আরএমএস তিতানিক ছিল তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী জাহাজ। ২৬৯ মিটার দীর্ঘ এই জাহাজটি তার সময়ের প্রযুক্তিগত চূড়ান্ত নিদর্শন ছিল। কিন্তু এর প্রথম যাত্রাতেই একটি হিমবাহের সাথে সংঘর্ষের ফলে ডুবে যায়, যাতে ১,৫০০ এরও বেশি যাত্রী ও নাবিক প্রাণ হারান। এই ট্র্যাজেডি সমুদ্রযাত্রার নিরাপত্তা বিধানে নতুন মানদণ্ড প্রণয়নে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, আরএমএস কুইন এলিজাবেথ ও আরএমএস কুইন মেরি যাত্রীবাহী জাহাজের নতুন যুগের সূচনা করে। এই জাহাজগুলো আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নির্মিত হয়। তবে ১৯৫০ এর দশকে বিমান ভ্রমণের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই বিশাল যাত্রীবাহী জাহাজগুলোর চাহিদা কমতে থাকে।
১৯৭০ এর দশক থেকে ক্রুজ শিপিং শিল্প নতুন করে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ও কার্নিভাল ক্রুজ লাইন এর অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ২০০৯ সালে রয়্যাল ক্যারিবিয়ান তাদের ওয়াসিস ক্লাস জাহাজ চালু করে, যা তখন পর্যন্ত নির্মিত সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী জাহাজ ছিল।
২০২২ সালে রয়্যাল ক্যারিবিয়ান আরও বড় আইকন অফ দ্য সিজ চালু করে। এর দৈর্ঘ্য ৩৬৫ মিটার এবং ওজন ২৫০,৮০০ টন। এতে ৫,৬১০ জন যাত্রী ও ২,৩৫০ জন কর্মী থাকতে পারেন। এই জাহাজে রয়েছে ২০টি রেস্তোরাঁ, ৬টি সুইমিং পুল, একটি আইস রিঙ্ক, এবং একটি সাফারি-থিম পার্ক।
ক্রুজ শিপিং শিল্পের বাজার মূল্য ২০১৯ সালে ২৭.৪ বিলিয়ন ডলার ছিল। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে ২০২০-২১ সালে এই শিল্প মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তবে ২০২৭ সাল নাগাদ এই শিল্পের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৫.১০% হারে বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
মালবাহী জাহাজের ক্ষেত্রে, কন্টেইনার শিপিং এর বিকাশ একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে। ২০১৮ সালে নির্মিত এমভি এভারগিভেন বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কন্টেইনার জাহাজগুলোর একটি। এর দৈর্ঘ্য ৪০০ মিটার, প্রস্থ ৫৯ মিটার, ওজন ২২০,৯৪০ টন এবং ধারণক্ষমতা ২০,১২৪ TEU (Twenty-foot Equivalent Unit)।
২০২১ সালের ২৩ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত এভারগিভেন সুয়েজ খালে আটকে পড়ে, যা বিশ্ব বাণিজ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এই ঘটনায় প্রতিদিন প্রায় ৯.৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ব্যাহত হয়েছিল। এই ঘটনা বিশাল জাহাজের ঝুঁকি সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
২০২২ সালে চালু হওয়া এমএসসি টেসা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কন্টেইনার জাহাজ। এর ধারণক্ষমতা ২৪,১১৬ TEU। এই ধরনের বিশাল জাহাজ অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক হলেও পরিবেশগত দিক থেকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (IMO) এর তথ্য অনুযায়ী, জাহাজ থেকে নির্গত গ্রীনহাউস গ্যাস বিশ্বব্যাপী মোট নির্গমনের প্রায় ৩%। IMO লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ২০৫০ সালের মধ্যে শিপিং সেক্টরের নির্গমন ৫০% কমানোর। এই লক্ষ্য অর্জনে হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়া চালিত জাহাজের গবেষণা চলছে।
স্বয়ংক্রিয় জাহাজের পরীক্ষামূলক প্রকল্পও চলছে। এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে জাহাজ পরিচালনার ব্যয় কমাতে ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশ্ব বাণিজ্যের ৯০% সমুদ্রপথে পরিবাহিত হয়। ২০২৩ সালে বিশ্ব নৌবহরের মোট মূল্য প্রায় ১.২ ট্রিলিয়ন ডলার। এই বিশাল শিল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির উদ্ভাবনের উপর।
সামগ্রিকভাবে, বিশাল জাহাজের ইতিহাস মানুষের অসীম সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতার একটি প্রতিচ্ছবি। প্রযুক্তিগত উন্নতি যেমন নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে, তেমনি নতুন চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি করেছে। আগামী দিনগুলোতে এই শিল্প কীভাবে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।