অনন্ত যাত্রায় শেষ নিঃশ্বাস: ২০২৪ সালে প্রায় ৯ হাজার অভিবাসীর মৃত্যু

গত বছর বিশ্বব্যাপী সীমান্ত পেরোতে গিয়ে প্রায় ৯ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে, যা টানা পঞ্চম বছরের মতো নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে। জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংগঠন (আইওএম) সম্প্রতি প্রকাশিত…

Srijita Chattopadhay

 

  • গত বছর বিশ্বব্যাপী সীমান্ত পেরোতে গিয়ে প্রায় ৯ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে, যা টানা পঞ্চম বছরের মতো নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে। জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংগঠন (আইওএম) সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০২৪ সালে কমপক্ষে ৮,৯৩৮ জন অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি হতে পারে। কারণ বিশ্বের অনেক অঞ্চলে অভিবাসীদের মৃত্যুর প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায় না, বহু ঘটনা অনুদ্ঘাটিত থেকে যায়। আইওএম-এর ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল ফর অপারেশনস উগোচি ড্যানিয়েলস বলেছেন, “বিশ্বব্যাপী অভিবাসীদের মৃত্যুর বর্ধমান সংখ্যা অগ্রহণযোগ্য এবং প্রতিরোধযোগ্য। প্রতিটি সংখ্যার পিছনে রয়েছে একজন মানুষ, যার অনুপস্থিতি তার পরিবারের জন্য বেদনাদায়ক”।

এশিয়া ছিল সবচেয়ে মারাত্মক অঞ্চল, যেখানে ২,৭৭৮ জন অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে। ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে ২,৪৫২ জন এবং আফ্রিকায় ২,২৪২ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীর জীবন যায়। আমেরিকাস অঞ্চলে কমপক্ষে ১,২৩৩ জন মারা গেছেন, যার মধ্যে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে অভূতপূর্ব ৩৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ইউরোপে ২৩৩ জন এবং কলম্বিয়া ও পানামার মধ্যবর্তী ডারিয়েন জঙ্গলে রেকর্ড সংখ্যক ১৭৪ জন অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে।

উল্লেখযোগ্যভাবে, সর্বাধিক মৃত্যুর কারণ হিসেবে সহিংসতা চিহ্নিত করা হয়েছে। গবেষণা অনুযায়ী, অভিবাসীদের মোট মৃত্যুর অন্তত ১০ শতাংশ সহিংসতার কারণে ঘটেছে। বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরান হয়ে তুরস্ক পর্যন্ত রুটে প্রায় ৬০০ জন মানুষ সহিংসতার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। সমুদ্র পথে যাত্রা করে ইউরোপে পৌঁছাতে চাওয়া বহু মানুষও টিউনিশিয়া ও লিবিয়া সীমান্তে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।

আইওএম’র মিসিং মাইগ্র্যান্টস প্রজেক্টের সমন্বয়ক জুলিয়া ব্ল্যাক বলেন, “মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া নিজেই ভয়াবহ, কিন্তু হাজার হাজার অভিবাসী যে অজ্ঞাতপরিচয় থেকে যাচ্ছেন তা আরও বেদনাদায়ক। পরিবারগুলি যারা প্রিয়জনকে হারিয়েছে তাদের অনিশ্চয়তা ও হতাশার পাশাপাশি, অভিবাসীদের সম্মুখীন ঝুঁকি সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্যের অভাব জীবন বাঁচানোর প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে”।

ভূমধ্যসাগর, যা ইউরোপে প্রবেশের প্রধান পথ, সেখানে গত দশকে ৩০,০০০ এরও বেশি অভিবাসী প্রাণ হারিয়েছেন। ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে ইতিমধ্যেই ৩৬৫ জন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। এছাড়া পশ্চিম আফ্রিকা থেকে স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ সংযোগকারী আটলান্টিক মহাসাগরের স্ট্রিপটিও বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক অভিবাসন রুটগুলির মধ্যে একটি।

এই রিপোর্ট প্রকাশের দিন কয়েক আগেই আইওএম ঘোষণা করেছে যে তারা বিশ্বব্যাপী অনেক “জীবন রক্ষাকারী” কর্মসূচি স্থগিত করে দিচ্ছে এবং শত শত কর্মচারীকে ছাঁটাই করছে। কারণ হিসেবে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাহায্য কাটছাঁটকে দায়ী করা হয়েছে, যা লাখ লাখ দুর্বল অভিবাসীদের উপর প্রভাব ফেলবে। জেনেভা-ভিত্তিক এই সংস্থাটি বহু উদ্বাস্তুদের সাহায্য করে থাকে, যারা যুদ্ধ ও সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসেন1

তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ভূমধ্যসাগরে কমপক্ষে ২৪,৫০৬ জন মানুষ মারা গেছেন অথবা নিখোঁজ হয়েছেন। ২০২০ সাল থেকে অভিবাসন পথে মৃত্যুর হার দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে1। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জোর্জিয়া মেলোনি দাবি করেছেন যে উত্তর আফ্রিকার দেশগুলির সাথে চুক্তির কারণে ইতালিতে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা প্রায় ৬০% কমেছে। ২০২৩ সালে ১,৫৭,৬৫১ জনের তুলনায় ২০২৪ সালে ৬৬,৩১৭ জন অভিবাসী ইতালিতে পৌঁছেছেন।

ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৫ তারিখে লিবিয়ার সাহারা মরুভূমিতে আল কুফ্রাহ জেলায় দুটি গণকবরে ৫৮ জন অভিবাসীর দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছে। আবার মার্চ ১২, ২০২৫ তারিখে মৌরিতানিয়া, মরক্কো এবং স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের মধ্যবর্তী জলে ৭০ জন নিখোঁজ হয়েছেন।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংগঠন তাদের রিপোর্টে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সমাধানের জন্য একটি “আন্তর্জাতিক, সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া” এর আহ্বান জানিয়েছে, যা আরও করুণ প্রাণহানি রোধ করতে সাহায্য করবে।

About Author
Srijita Chattopadhay

সৃজিতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক। তিনি একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক এবং সাংবাদিক, যিনি তার লেখা দ্বারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধি তুলে ধরতে সদা উদ্যমী। সৃজিতার লেখার ধারা মূলত সাহিত্য, সমাজ এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন দিককে ঘিরে আবর্তিত হয়, যেখানে তিনি তার গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বিশ্লেষণী দক্ষতার পরিচয় দেন। তাঁর নিবন্ধ ও প্রতিবেদনগুলি পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, যা তার বস্তুনিষ্ঠতা ও সংবেদনশীলতার পরিচয় বহন করে। সৃজিতা তার কর্মজীবনে ক্রমাগত নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে বদ্ধপরিকর, যা তাকে বাংলা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।