LED lights history in Chandannagar: চন্দননগর শহরের নাম শুনলেই মনে ভেসে ওঠে রঙিন আলোর ঝলমলে দৃশ্য। একসময় ফরাসি উপনিবেশ থাকা এই শহরটি আজ বাংলার আলোর রাজধানী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু জানেন কি, এই আলোর শহরের ইতিহাস কতটা পুরনো? কীভাবে ঘুঁটের আলো থেকে শুরু করে আজকের অত্যাধুনিক LED বাল্বের যুগে পৌঁছেছে চন্দননগর?
চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই অবাক করা কাহিনি।১৮ শতকের শেষের দিকে চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পূজার সময় প্রথম আলোর ব্যবহার শুরু হয়। তখন ঘুঁটের আলো দিয়ে পূজামণ্ডপ সাজানো হত। ধীরে ধীরে কেরোসিনের লণ্ঠন, গ্যাসের আলো এবং পরে বিদ্যুতের আলো এসে যায়। কিন্তু প্রকৃত পরিবর্তন আসে ১৯৬০ এর দশকে। তখন শ্রীধর দাস নামে এক প্রতিভাবান যুবক নতুন ধরনের আলোর সাজ তৈরি করেন। তিনি ছোট ছোট বাল্ব দিয়ে নকশা তৈরি করে সবাইকে অবাক করে দেন।শ্রীধর দাসের এই উদ্ভাবন চন্দননগরের আলোর ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে। তাঁর তৈরি করা আলোর প্যানেল দেখে মুগ্ধ হয় সবাই। ধীরে ধীরে তিনি বিশ্বখ্যাত হয়ে ওঠেন।
১৯৮৫ সালে মস্কোতে তাঁর কাজের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৩ সালে লন্ডনের টেমস উৎসবে তিনি ১,৩০,০০০ টুনি বাল্ব দিয়ে ৭ মিটার লম্বা একটি ময়ূর নৌকা তৈরি করেন। এরপর থেকে তাঁর খ্যাতি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।শ্রীধর দাসের পথ ধরে অনেকেই এগিয়ে আসেন। বাবু পাল, সুকুমার বিশ্বাস, পিন্টু দাস প্রমুখ শিল্পীরা চন্দননগরের আলোর ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করেন। তাঁদের হাতে গড়ে ওঠা নানা ধরনের আলোর নকশা দেখে মুগ্ধ হয় সবাই। জগদ্ধাত্রী পূজার সময় চন্দননগর যেন আলোর শহরে পরিণত হয়। লক্ষ লক্ষ বাল্বের আলোয় সাজানো হয় পুরো শহর।কিন্তু সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তিরও পরিবর্তন হয়েছে। আজ আর সেই পুরনো টুনি বাল্ব নেই। তার জায়গা নিয়েছে LED বাল্ব। কম বিদ্যুৎ খরচে বেশি আলো দেওয়ার কারণে LED বাল্ব এখন সবার পছন্দের। চন্দননগরের শিল্পীরাও ধীরে ধীরে LED বাল্বের দিকে ঝুঁকছেন। ২০০৫ সালে কাশীনাথ নিয়োগী নামে এক শিল্পী প্রথম LED বাল্ব দিয়ে আলোর নকশা তৈরি করেন।
তিনি ১৮০,০০০ LED বাল্ব দিয়ে ৩০ ফুট লম্বা ও ১২ ফুট উঁচু একটি বিশাল ড্রাগন তৈরি করেন।LED বাল্বের ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে চন্দননগরের আলোর শিল্পও নতুন মাত্রা পেয়েছে। আগে যেখানে শুধু জগদ্ধাত্রী পূজার সময়ই আলোর চাহিদা থাকত, এখন সারা বছরই নানা অনুষ্ঠানে আলোর সাজ লাগানো হয়। এতে শিল্পীদের কাজের সুযোগও বেড়েছে। তবে পুরনো প্রজন্মের অনেক শিল্পীই মনে করেন, LED বাল্বের ব্যবহার বাড়লেও সেই পুরনো টুনি বাল্বের মতো সৌন্দর্য এতে নেই।ভারত সরকারের উজ্জ্বলা প্রকল্পের মাধ্যমে LED বাল্বের ব্যবহার আরও বেড়েছে। ২০১৪ সালে যেখানে দেশে মাত্র ৫ মিলিয়ন LED বাল্ব বিক্রি হত, ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭০ মিলিয়নে। এর ফলে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়েছে বছরে ৩০ টেরাওয়াট ঘণ্টা। LED বাল্বের দামও কমেছে। ২০১৪ সালে যেখানে একটি LED বাল্বের দাম ছিল ৪০০ টাকা, ২০১৮ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭০ টাকায়।চন্দননগরের আলোর শিল্পীরা এখন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। একদিকে যেমন LED বাল্বের ব্যবহার বাড়ছে, তেমনি চীনা LED বাল্বের আমদানিও বাড়ছে। এতে দেশীয় শিল্পীদের কাজের সুযোগ কমছে। তবে সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে।
কেন রাতের বেলায় পোকামাকড়ের ভিড় বাড়ে আলোর চারপাশে ?
LED লাইট তৈরির জন্য ৬,২৩৮ কোটি টাকার প্রোডাকশন লিংকড ইনসেন্টিভ স্কিম চালু করা হয়েছে। এর ফলে আগামী পাঁচ বছরে LED শিল্পে ২৩ বিলিয়ন ডলারের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।চন্দননগরের আলোর শিল্প আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে। একদিকে যেমন নতুন প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তেমনি পুরনো ঐতিহ্যকেও ধরে রাখতে হচ্ছে। তবে চন্দননগরের শিল্পীরা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত। তাঁরা নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরও সুন্দর ও আকর্ষণীয় আলোর নকশা তৈরি করছেন। LED বাল্বের সাহায্যে এখন তাঁরা আরও জটিল ও গতিশীল নকশা তৈরি করতে পারছেন।চন্দননগরের আলোর শিল্প শুধু একটি শিল্প নয়, এটি একটি সংস্কৃতি। এই শিল্পের মাধ্যমে শুধু আলোই তৈরি হয় না, তৈরি হয় আনন্দ, উৎসব ও সৌন্দর্যবোধ। ঘুঁটের আলো থেকে শুরু করে LED বাল্ব পর্যন্ত এই দীর্ঘ যাত্রায় চন্দননগরের শিল্পীরা দেখিয়েছেন তাঁদের সৃজনশীলতা ও দক্ষতা।
আজ যখন গোটা বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, তখন কম বিদ্যুৎ খরচে বেশি আলো দেওয়ার এই শিল্প আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।চন্দননগরের আলোর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। নতুন প্রযুক্তি ও পুরনো ঐতিহ্যের সমন্বয়ে এই শিল্প আরও সমৃদ্ধ হবে। আগামী দিনে হয়তো আমরা দেখব আরও অভিনব ধরনের আলোর নকশা, যা শুধু আমাদের চোখ জুড়িয়ে দেবে না, পরিবেশের জন্যও হবে বন্ধুসুলভ। চন্দননগরের আলোর শিল্পীরা সেই স্বপ্ন দেখছেন, আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে।