Legal Action Against Dowry Torture: যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের শিকার হওয়া একটি গুরুতর অপরাধ যার বিরুদ্ধে ভারতে কঠোর আইনি ব্যবস্থা রয়েছে। যদি আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ এই ধরনের নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে জানা প্রয়োজন যে আপনার অধিকার রক্ষার জন্য আইনি পথ খোলা রয়েছে। ভারতীয় আইনে যৌতুক নেওয়া এবং দেওয়া দুটোই দণ্ডনীয় অপরাধ। ১৯৬১ সালের যৌতুক নিরোধক আইন এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারা নারীদের এই ধরনের নির্যাতন থেকে সুরক্ষা প্রদান করে।
যৌতুক নির্যাতন কী এবং কেন এটি একটি গুরুতর অপরাধ
যৌতুক নির্যাতন বলতে বোঝায় বিয়ের পর স্বামী বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত অর্থ, সম্পত্তি বা মূল্যবান জিনিসপত্রের দাবি করা এবং সেই দাবি পূরণ না হলে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা। এই ধরনের নির্যাতন কখনো কখনো মৃত্যু পর্যন্ত পর্যবসিত হয়।
জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারতে ৬,৪৫০টি যৌতুক মৃত্যুর ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। উত্তরপ্রদেশে সবচেয়ে বেশি ২,২১৮টি ঘটনা ঘটেছে, এরপর রয়েছে বিহার (১,০৫৭) এবং মধ্যপ্রদেশ (৫১৮)। একই বছরে যৌতুক নিরোধক আইনের অধীনে ১৩,৪৭৯টি মামলা দায়ের হয়েছে।
ভারতীয় আইনে যৌতুক নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রধান আইনি কাঠামো
যৌতুক নিরোধক আইন, ১৯৬১
এই আইনটি ১৯৬১ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে এবং এটি যৌতুক সংক্রান্ত সকল অপরাধের বিরুদ্ধে প্রধান আইনি হাতিয়ার। আইনের ধারা ৩ অনুযায়ী, যৌতুক দেওয়া এবং নেওয়া উভয়ই অপরাধ। এই অপরাধের জন্য সর্বনিম্ন পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে পনেরো হাজার টাকা জরিমানা বা যৌতুকের মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা হতে পারে।
আইনের ধারা ৪ অনুযায়ী, যৌতুকের দাবি করাও একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। এর জন্য সর্বনিম্ন ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড এবং দশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
ভারতীয় দণ্ডবিধির প্রাসঙ্গিক ধারাসমূহ
ধারা ৪৯৮(ক) অনুযায়ী, স্বামী বা তার আত্মীয়রা স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করলে তার জন্য সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। এই ধারার অধীনে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করা যায় এবং এটি একটি অজামিনযোগ্য অপরাধ।
ধারা ৩০৪(খ) যৌতুক মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত। বিয়ের সাত বছরের মধ্যে কোনো নারীর মৃত্যু হলে এবং প্রমাণিত হলে যে সে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার ছিল, তাহলে এই ধারা প্রযোজ্য হবে। এর শাস্তি সর্বনিম্ন সাত বছরের কারাদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত।
যৌতুক নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পদ্ধতি
প্রাথমিক অভিযোগ দায়ের
সবার প্রথমে নিকটস্থ থানায় গিয়ে প্রাথমিক তথ্য প্রতিবেদন (এফআইআর) দাখিল করতে হবে। এফআইআর দাখিল করার সময় নির্যাতনের বিস্তারিত বিবরণ, তারিখ, সময়, এবং যে কোনো সাক্ষীর তথ্য দিতে হবে। শারীরিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের প্রতিবেদন এবং ছবি জমা দিতে হবে।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
-
বিয়ের সার্টিফিকেট
-
পরিচয় প্রমাণপত্র (আধার কার্ড, ভোটার আইডি)
-
ঠিকানার প্রমাণপত্র
-
যৌতুক সংক্রান্ত যেকোনো কাগজপত্র বা রসিদ
-
মেডিকেল রিপোর্ট (প্রয়োজনে)
-
অডিও বা ভিডিও প্রমাণ (যদি থাকে)
বিকল্প অভিযোগের পথ
থানা ছাড়াও অন্যান্য মাধ্যমেও অভিযোগ করা যায়:
-
নারী হেল্পলাইনে যোগাযোগ করা যায়
-
জাতীয় নারী কমিশনে অভিযোগ করা যায়
-
রাজ্য নারী কমিশনে অভিযোগ দায়ের করা যায়
বর্তমান পরিস্থিতি এবং পরিসংখ্যান
জাতীয় নারী কমিশনের ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, মোট ২৫,৭৪৩টি অভিযোগের মধ্যে ১৭% (৪,৩৮৩টি) ছিল যৌতুক নির্যাতন সংক্রান্ত। একই বছরে ২৯২টি যৌতুক মৃত্যুর অভিযোগ এসেছে। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে যৌতুক নির্যাতন এখনও একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা।
উত্তরপ্রদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি ৫৪% অভিযোগ এসেছে, এরপর দিল্লি (৯%), মহারাষ্ট্র (৫.১%), বিহার (৪.৮%), মধ্যপ্রদেশ (৪.২%) এবং হরিয়ানা (৪.১%)।
আইনি সহায়তা এবং সুরক্ষা ব্যবস্থা
গার্হস্থ্য সহিংসতা থেকে নারী সুরক্ষা আইন, ২০০৫
এই আইনটি যৌতুক নির্যাতনকে গার্হস্থ্য সহিংসতার অন্তর্ভুক্ত করে এবং আক্রান্ত নারীদের জন্য বিশেষ সুরক্ষা প্রদান করে। এই আইনের অধীনে সুরক্ষা আদেশ, বাসস্থান আদেশ এবং ভরণপোষণের আদেশ পাওয়া যায়।
আইনি প্রক্রিয়ায় সহায়তা
যৌতুক নির্যাতনের মামলায় আক্রান্ত ব্যক্তি বিনামূল্যে আইনি সহায়তা পেতে পারেন। রাজ্য আইনি সেবা কর্তৃপক্ষ এই ধরনের সহায়তা প্রদান করে থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন এনজিও এবং মানবাধিকার সংস্থা এই ক্ষেত্রে সহায়তা করে।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং সচেতনতা
যৌতুক নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। পরিবার এবং সমাজের সকল স্তরে এই বিষয়ে আলোচনা এবং শিক্ষার প্রয়োজন। বিশেষত নারী শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এই সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
প্রাথমিক সতর্কতা
-
বিয়ের আগেই পরিবারগুলোর মধ্যে স্পষ্ট আলোচনা করা
-
যৌতুক দাবি করা হলে তা প্রত্যাখ্যান করা
-
প্রয়োজনে আইনি পরামর্শ নেওয়া
-
আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখা
সামাজিক পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে চলা
যৌতুক নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করাও অপরিহার্য। আধুনিক সমাজে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে এবং নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে এই ধরনের নির্যাতন কমে আসবে।
সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা নারী সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। জাতীয় নারী কমিশন এবং রাজ্য নারী কমিশনগুলো নিয়মিত সেমিনার, কর্মশালা এবং প্রচারণার মাধ্যমে যৌতুক প্রথার কুফল সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তুলছে।
যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের শিকার হলে নীরবে সহ্য না করে আইনি পথে এর সমাধান খোঁজা উচিত। ভারতীয় আইন এই ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রেখেছে এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে। সমাজের প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব হলো এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং একটি যৌতুকমুক্ত সমাজ গড়ে তোলায় অবদান রাখা। মনে রাখবেন, যৌতুক একটি সামাজিক অভিশাপ এবং এর বিরুদ্ধে লড়াই করা আমাদের সকলের নৈতিক ও আইনি দায়িত্ব।