SMA fundraising campaign: মাত্র ১৫ মাস বয়সী আস্মিকা দাসের জীবন বাঁচাতে ৯ কোটি টাকা সংগ্রহের এক নজিরবিহীন উদাহরণ তৈরি হয়েছে। বিরল ও প্রাণঘাতী জেনেটিক রোগ স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি (এসএমএ) টাইপ-১-এ আক্রান্ত আস্মিকার চিকিৎসার জন্য পরিবারের পক্ষে এত বিপুল অর্থ জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। তাই সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন সেলিব্রিটির সহায়তায় দীর্ঘ সাত মাস ধরে চলা ক্রাউড ফান্ডিং অভিযানে অবশেষে ৯ কোটি টাকা সংগ্রহ সম্ভব হয়েছে, যা শিশুটির চিকিৎসার একমাত্র আশার আলো হয়ে উঠেছে।
আস্মিকার জন্মের পর থেকেই তার হাত-পা ছিল অবশ। ধীরে ধীরে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে সে। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, এসএমএ টাইপ-১ রোগে আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত নিজেরা বসতে বা হাঁটতে পারে না, শ্বাস-প্রশ্বাস ও খাওয়া-দাওয়াতেও সমস্যা হয়। এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত দুই বছর বয়সের আগেই গুরুতর জটিলতায় পড়ে। চিকিৎসকরা কলকাতা, চেন্নাই ও বেঙ্গালুরুর বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শের পর জানিয়েছিলেন, আস্মিকার বাঁচার একমাত্র উপায় ‘জোলজেন্সমা’ (Zolgensma) নামে একটি জিন থেরাপি ইনজেকশন, যার দাম ভারতীয় বাজারে ১৬ কোটি টাকা। তবে এক ডিস্ট্রিবিউটর কিছুটা ছাড় দিয়ে ৯ কোটি টাকায় ইনজেকশনটি দিতে রাজি হন।
এত বিশাল অঙ্কের অর্থ জোগাড়ের জন্য আস্মিকার পরিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার শুরু করেন। বহু সাধারণ মানুষ, সমাজকর্মী, এমনকি গায়িকা শুভমিতা ব্যানার্জি, রূপম ইসলাম ও রূপসা দাসগুপ্তার মতো সেলিব্রিটিরাও পাশে দাঁড়ান। একের পর এক সংবাদমাধ্যমে আস্মিকার গল্প ছড়িয়ে পড়ে। শেষপর্যন্ত, সাত মাসের চেষ্টায় ৮.৪ কোটি টাকা সংগ্রহ হয়। বাকি ৬০ লক্ষ টাকা দেন মাতুয়া মাতৃ সেনা চ্যারিটেবল ট্রাস্ট। এই অর্থের চেক আস্মিকার বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেন সংসদ সদস্য শান্তনু ঠাকুর।
এসএমএ রোগের চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল কেন? এই রোগটি একটি জেনেটিক ডিসঅর্ডার, যেখানে শরীরের মোটর নিউরন ধ্বংস হয়ে যায়, ফলে পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শিশুদের স্বাভাবিকভাবে বসা, দাঁড়ানো, হাঁটা বা খাওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়। রোগটি সাধারণত শিশুর জন্মের পরপরই ধরা পড়ে এবং দ্রুত চিকিৎসা না পেলে জীবনসংকট দেখা দেয়। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও কার্যকরী চিকিৎসা হল জিন থেরাপি ইনজেকশন ‘জোলজেন্সমা’, যা একবারই দিতে হয়, কিন্তু এর দাম ভারতীয় মুদ্রায় ১৬-১৮ কোটি টাকার মতো। এই বিপুল অর্থ সাধারণ পরিবারের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়, তাই ক্রাউড ফান্ডিংই একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ ধরনের ঘটনা শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা আস্মিকার ক্ষেত্রেই নয়, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য, এমনকি বাংলাদেশেও দেখা যাচ্ছে। কেরালার ১৮ মাস বয়সী মোহাম্মদ নামের এক শিশুর জন্য মাত্র কয়েক দিনের প্রচেষ্টায় ১৮ কোটি টাকা সংগ্রহ হয়েছিল। দিল্লির কানভ জাংড়া, জয়পুরের শিশুরাও একইভাবে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি ও সাহায্যে জীবন ফিরে পেয়েছে। বাংলাদেশেও প্রথমবারের মতো একটি শিশুকে জিন থেরাপি বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছিল একটি আন্তর্জাতিক প্রকল্পের আওতায়।
এসএমএ আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্য দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বিশেষ ক্লিনিক গড়ে উঠছে। তবে চিকিৎসা খরচ অত্যন্ত বেশি হওয়ায়, অনেক পরিবারই অসহায়। চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকার, সমাজের বিত্তবানরা এবং ওষুধ কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এই রোগের চিকিৎসা সবার নাগালে আনা সম্ভব নয়। অনেক ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান কিছু ওষুধ বিনামূল্যে বা ছাড়ে দিচ্ছে, তবে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার খরচ চালিয়ে যাওয়া একক পরিবারের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
আস্মিকার পরিবারের মতো হাজারো পরিবার আজও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ক্রাউড ফান্ডিংয়ের এই সাফল্য দেখিয়ে দিল, মানুষের সহানুভূতি, সচেতনতা এবং সামাজিক উদ্যোগ একত্রিত হলে অসম্ভবও সম্ভব হয়। চিকিৎসার জন্য সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ নির্দিষ্ট বয়সের আগেই ইনজেকশন দিতে না পারলে সুফল পাওয়া যায় না। তাই সমাজের সকল স্তরের মানুষের এগিয়ে আসা জরুরি, যাতে আরও অনেক এসএমএ আক্রান্ত শিশু নতুন জীবন পেতে পারে।
এসএমএ রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো, সরকারি সহায়তা বৃদ্ধি, ওষুধের দাম কমানো এবং চিকিৎসার সুযোগ সহজলভ্য করাই এখন সময়ের দাবি। আস্মিকার গল্প শুধু একটি শিশুর নয়, বরং হাজারো পরিবারের আশা ও সংগ্রামের প্রতীক, যারা সন্তানের মুখে হাসি ফেরাতে সমাজের কাছে হাত বাড়িয়েছে। এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানবিকতার শক্তি কতটা অসীম।