Loknath Puja rituals 2025: বাংলার ঘরে ঘরে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে পালিত হয় বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর পুজো। জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৯ তারিখে এই মহান সাধকের তিরোধান দিবস উপলক্ষে ভক্তরা বিশেষ পুজো অর্চনা করে থাকেন। এবছর ২০২৫ সালে লোকনাথ পুজো আসছে ৩ জুন, মঙ্গলবার। এই পবিত্র দিনে সঠিক নিয়মে পুজো করলে বাবা লোকনাথের কৃপায় সকল মনোকামনা পূর্ণ হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। আসুন জেনে নিই এই বিশেষ দিনের সম্পূর্ণ তথ্য ও পুজোর সঠিক নিয়ম।
পুজোর তারিখ ও শুভ মুহূর্ত
এবছর ২০২৫ সালে লোকনাথ পুজো অনুষ্ঠিত হবে ৩ জুন, মঙ্গলবার। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী এই দিনটি ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ। এই তিথিতেই ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের বারদী আশ্রমে মহাসমাধি লাভ করেছিলেন।
পুজোর শুভ সময় সকাল ৬টা ৪০ মিনিট থেকে শুরু হয়ে পরের দিন সকাল ৯টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে। তবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে দুপুরেও একটি শুভ সময় রয়েছে – দুপুর ১২টা ৬ মিনিট থেকে বিকেল ২টা ৪৭ মিনিট পর্যন্ত। এই সময়গুলোর মধ্যে যেকোনো সময়ে পুজো করা যেতে পারে।
লোকনাথ পুজোর প্রয়োজনীয় উপকরণ
বাবা লোকনাথের পুজো অত্যন্ত সাধারণ ও সহজ। তিনি বিশেষ আড়ম্বর পছন্দ করেন না, বরং ভক্তির শুদ্ধতাই তাঁর কাছে প্রধান। লোকনাথ পুজোর জন্য যে উপকরণগুলি প্রয়োজন:
মুখ্য উপকরণ:
- মিছরি (এটি অবশ্যই দিতে হবে)
- অমৃতি
- সাদা ফুল (বিশেষত নীল শাপলা ফুল)
- বেলপাতা
- ধূপ ও দীপ
- চন্দনের পেস্ট
- তালশাঁস
- কালোজাম
- যেকোনো সাদা মিষ্টি
ভোগের জন্য:
- খিচুড়ি
- তরকারি
- লাবড়া
- চাটনি
- বিভিন্ন নিরামিষ পদ
মিছরি হলো বাবা লোকনাথের সবচেয়ে প্রিয় ভোগ। তিনি তাঁর ভক্তদের মুখের ভাষা যেন মিষ্টি হয় সেজন্য মিছরি খেতে দিতেন। তাই এই পুজোতে মিছরি না দিলে পুজো অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
পুজোর সঠিক নিয়ম ও বিধি
লোকনাথ পুজো করার জন্য প্রথমে দেবাদিদেব মহাদেবের পুজো করতে হয়। কারণ শাস্ত্র অনুযায়ী বাবা লোকনাথ স্বয়ং শিবের অবতার।
পুজোর ধাপসমূহ:
প্রস্তুতি পর্ব:
- সকালে স্নান করে পরিষ্কার কাপড় পরুন
- পুজোর স্থান পরিষ্কার করে নিন
- বাবা লোকনাথের ছবি বা মূর্তি স্থাপন করুন
পুজোর প্রক্রিয়া:
- প্রথমে গণেশ পুজো করুন
- এরপর শিবের পুজো করুন
- বাবা লোকনাথের চরণে ফুল অর্পণ করুন
- বিশেষভাবে নীল শাপলা ফুল দিন
- ধূপ জ্বালিয়ে আরতি করুন
- চন্দন লেপন করুন
- মিছরি ও অমৃতি নিবেদন করুন
- মনের ইচ্ছা প্রকাশ করুন
বাবা লোকনাথের মাহাত্ম্য ও জীবনী
বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী ছিলেন একজন মহান সাধক। তিনি ১৭৩০ সালের ৩১ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাটের চৌরাশি চাকলার অন্তর্গত কচুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল রামনারায়ণ ঘোষাল। মাত্র ১১ বছর বয়সে তাঁর পৈতে হয় এবং তিনি আচার্য গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
তাঁর বাল্যবন্ধু বেণীমাধবের সাথে তিনি দীর্ঘ সাধনা করেছিলেন। দিনের পর দিন কঠিন তপস্যার মাধ্যমে তিনি সিদ্ধিলাভ করেন। তিনি ভক্তদের সর্বদা সৎ পথে চলার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, “রণে বনে জলে জঙ্গলে যেখানেই বিপদে পড়িবে আমাকে স্মরণ করিও আমি রক্ষা করিব।”
১৮৯০ সালের ১ জুন (১৯ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৭ বঙ্গাব্দ) তিনি ১৬০ বছর বয়সে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের বারদী আশ্রমে মহাসমাধি লাভ করেন।
লোকনাথ পুজোর বিশেষ ফল ও মাহাত্ম্য
ভক্তদের বিশ্বাস অনুযায়ী লোকনাথ পুজো করলে অসংখ্য ফল পাওয়া যায়:
আধ্যাত্মিক ফল:
- মানসিক শান্তি লাভ
- আধ্যাত্মিক উন্নতি
- পাপমুক্তি
- দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি
জাগতিক ফল:
- অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি
- সংসারের সুখ-শান্তি
- রোগমুক্তি
- বিপদ থেকে রক্ষা
বাবা লোকনাথ সকল ভক্তকে নিজের সন্তানের মতো দেখেন। তাই তাঁর কাছে সাচ্চা হৃদয়ে প্রার্থনা করলে তিনি অবশ্যই সাহায্য করেন।
পুজোর সময় বিশেষ সতর্কতা
লোকনাথ পুজোর সময় কিছু বিষয়ে বিশেষ সতর্ক থাকতে হয়:
- পুজোর সময় মনে কোনো অশুভ চিন্তা আনবেন না
- অবশ্যই মিছরি নিবেদন করতে ভুলবেন না
- সাদা ফুল বিশেষত নীল শাপলা ফুল ব্যবহার করুন
- পুজোর সময় সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে করুন
- অহংকার ত্যাগ করে বিনীত হয়ে পুজো করুন
বর্তমানে লোকনাথ পুজোর প্রভাব
আজকের যুগে লোকনাথ পুজো আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। শুধু বাংলা অঞ্চলেই নয়, সারা ভারতবর্ষে এমনকি বিদেশেও বাঙালি পরিবারগুলো এই পুজো পালন করে। বিশেষত কলকাতা, ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য বড় শহরগুলোতে বহু মন্দিরে এই দিন বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
আধুনিক জীবনের যান্ত্রিকতা ও চাপের মধ্যে মানুষ বাবা লোকনাথের কাছে শান্তি খোঁজে। তাঁর সহজ-সরল পুজো পদ্ধতি ও ভক্তবৎসল স্বভাবের কারণে সকল বয়সের মানুষ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়।
বাবা লোকনাথের লোকনাথ পুজো শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই পুজোর মাধ্যমে আমরা শুধু আধ্যাত্মিক উন্নতিই করি না, বরং আমাদের মানবিক গুণাবলীর বিকাশও ঘটে। তাঁর শিক্ষা অনুসরণ করে আমরা সৎ পথে চলার অনুপ্রেরণা পাই এবং সকলের প্রতি করুণা ও ভালোবাসার মনোভাব গড়ে তুলি। তাই এই পবিত্র দিনে নিষ্ঠা ও ভক্তিসহকারে বাবা লোকনাথের পুজো করি এবং তাঁর আশীর্বাদে জীবনে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি লাভ করি।