বাঙালি মায়েদের কাছে সন্তানের মঙ্গল কামনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্রতগুলির মধ্যে অন্যতম হল লুণ্ঠনষষ্ঠীর ব্রত। শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে পালিত এই পবিত্র ব্রত কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি মায়েদের অন্তরের গভীর থেকে উৎসারিত সন্তানের প্রতি ভালোবাসা ও রক্ষার আকুতি। ২০২৫ সালে এই বিশেষ দিনটি কবে পড়ছে এবং কীভাবে এই ব্রত পালন করলে সন্তানের সর্বোচ্চ মঙ্গল হয়, তা জেনে নেওয়া যাক বিস্তারিতভাবে।
২০২৫ সালে লুণ্ঠনষষ্ঠীর তারিখ ও শুভ সময়
এবছর ৩০ জুলাই, বুধবার পালিত হবে লুণ্ঠনষষ্ঠীর ব্রত। বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এই দিনটি পড়েছে ১৩ শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দে।
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুসারে ষষ্ঠী তিথি শুরু হবে ২৯ জুলাই, মঙ্গলবার রাত ১২টা ৪৮ মিনিটে এবং শেষ হবে ৩০ জুলাই, বুধবার রাত ২টো ৪২ মিনিটে। গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা অনুসারে তিথি শুরু হবে ২৯ জুলাই রাত ১টা ২৯ সেকেন্ডে এবং শেষ হবে ৩০ জুলাই রাত ২টো ২৬ মিনিট ২২ সেকেন্ডে।
ব্রত পালনের আদর্শ সময়
শাস্ত্র অনুযায়ী, ষষ্ঠী তিথির প্রধান অংশে অর্থাৎ দিনের বেলায় এই ব্রত পালন করাই সর্বোত্তম। সাধারণত সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই ব্রত পালন করা হয়। তবে তিথি অনুযায়ী যেদিন ষষ্ঠী তিথি বেশি থাকে, সেদিনই মূল ব্রত পালনের দিন হিসেবে ধরা হয়।
লুণ্ঠনষষ্ঠী ব্রতের ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক পটভূমি
দেবী ষষ্ঠীর মাহাত্ম্য
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, প্রাচীনকালে রাজা প্রিয়ব্রত দেবী ষষ্ঠীর পুজো করে তাঁর মৃত সন্তানদের ফিরে পেয়েছিলেন। এই ঘটনার পর থেকেই দেবী ষষ্ঠীর পুজোর প্রচলন শুরু হয়। দেবী ষষ্ঠী কেবল সন্তানদাত্রী নন, তিনি সন্তানের রক্ষাকারিণী দেবীও বটে।
লুণ্ঠনষষ্ঠী নামের উৎপত্তি
এই ব্রতের নাম লুণ্ঠনষষ্ঠী হওয়ার পেছনে রয়েছে একটি চমকপ্রদ কাহিনি। মা ষষ্ঠীর পূজার লোটন চুরি বা লুঠ হয়েছিল বলে এই ব্রতের নাম হয়েছে লুণ্ঠনষষ্ঠী। অনেক ক্ষেত্রে একে লোটনষষ্ঠী নামেও ডাকা হয়।
লুণ্ঠনষষ্ঠী ব্রতের কাহিনি ও শিক্ষা
প্রথম কাহিনি: কাদম্বিনী ও বিমলীর পিসির গল্প
অতীতে কোনো এক গ্রামে কাদম্বিনী নামে এক গৃহিণী ছিলেন, যিনি প্রতি বছর ঘটা করে লোটনষষ্ঠীর পূজা করতেন। একদিন বিমলীর পিসি নামে এক মহিলা লোভের বশে কাদম্বিনীর পূজার তিনটি সোনার লোটন চুরি করে ফেলেন। এর ফলে তার তিন পুত্র কঠিন অসুখে পড়ে। স্বপ্নে মা ষষ্ঠী তাকে লোটন ফেরত দিতে বলেন। লোটন ফেরত দেওয়ার পর তার সন্তানরা সুস্থ হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় কাহিনি: ব্রাহ্মণ পরিবারের গল্প
আরেকটি কাহিনি অনুযায়ী, এক ব্রাহ্মণ পরিবারে বউয়ের সাত সন্তান ও ননদের দুই সন্তান ছিল। ননদ গোপনে তিনটি লোটন চুরি করে বউয়ের নামে দোষ দেয়। বউ ক্রোধে সন্তানদের মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি করলে তার সাত সন্তান মারা যায়। পরে মা ষষ্ঠীর কৃপায় বাঁশপাতা দিয়ে জল ছিটিয়ে সব সন্তান বেঁচে ওঠে।
কাহিনিগুলোর শিক্ষা
এই কাহিনিগুলো থেকে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাই:
পরের সম্পত্তিতে লোভ করা অন্যায়
সন্তানের মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি করা উচিত নয়
মা ষষ্ঠীর পূজায় নিষ্ঠা ও ভক্তি থাকা জরুরি
অন্যায় করলে তার খেসারত দিতে হয়
লুণ্ঠনষষ্ঠী ব্রত পালনের বিস্তারিত নিয়মাবলী
কারা এই ব্রত করতে পারেন?
এই ব্রত কেবলমাত্র সন্তানবতী মহিলারাই পালন করতে পারেন। গর্ভবতী মহিলারাও এই ব্রত পালন করতে পারেন। তবে বন্ধ্যা, সন্তান উৎপাদনে অক্ষম বা বিধবা মহিলাদের এই ব্রত পালনের বিধান নেই।
ব্রতের প্রয়োজনীয় উপকরণ
লুণ্ঠনষষ্ঠী ব্রত পালনের জন্য যে উপকরণগুলো প্রয়োজন:
আতপ চাল
ক্ষীরের নাড়ু বা লোটন (৭টি বা ৯টি)
আখের গুড়
ঘি
ঝিঙে
কড়াই
ডাব
ফল ও মিষ্টি
বাঁশপাতা
বটের ডাল
হলুদ বাটা
দই ও তেল
পূজার বিধান ও নিয়ম
প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীর দিন ষোলো মুঠনিতে বাঁশপাতা বেঁধে সেটি জলের মধ্যে পুঁতে দিতে হয়। মেঝেতে আলপনা দিয়ে তার সামনে বটের ডাল রাখতে হয়। এরপর ঘটস্থাপন করে তাতে তেল, হলুদ বাটা ও দই দিতে হয়।
সন্তানের সংখ্যা অনুযায়ী জালি ঝিঙে এবং কিছুটা কড়াই ভেজানো দিয়ে ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে মা ষষ্ঠীর পূজা করতে হয়। সাতটি বা নয়টি ক্ষীরের নাড়ু বা লোটন তৈরি করে ষষ্ঠীদেবীর কাছে নৈবেদ্য দিতে হয়।
লুণ্ঠনষষ্ঠী ব্রতের খাদ্য নিয়মাবলী
উপবাসের নিয়ম
পূজার দিন সম্পূর্ণ অন্নভোজন নিষিদ্ধ। তবে কঠোর নিয়ম মেনে কিছু খাবার খাওয়া যায়:
দিনের বেলায় খাওয়া যায়:
লুচি
তরকারি
মিষ্টি
রাতের বেলায় খাওয়া যায়:
ফল
মিষ্টি
ডাব
অন্য কোনো খাবার নয়
ব্রত সমাপনের পদ্ধতি
পূজার শেষে ব্রতকথা শুনে জল খেয়ে উপবাস ভাঙতে হয়। ব্রতীনীরা দিনের বেলায় নির্ধারিত খাবার খেয়ে উপোস ভঙ্গ করতে পারেন।
লুণ্ঠনষষ্ঠী ব্রত পালনের অলৌকিক ফলাফল
সন্তানের মঙ্গল সুনিশ্চিত হয়
এই ব্রত পালন করলে পুত্র-কন্যাদের অকালমৃত্যু হয় না। সন্তানের দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্যের জন্য এই ব্রত অত্যন্ত কার্যকর বলে মানা হয়। মায়েরা এই ব্রত পালন করে পুত্রশোক থেকে মুক্ত থাকেন।
সংসারে সুখ-শান্তি
নিয়মিত এই ব্রত পালন করলে সংসারে কোনো অভাব থাকে না এবং সংসার সুখকর হয়ে ওঠে। পারিবারিক শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্যও এই ব্রত বিশেষ উপকারী।
আধ্যাত্মিক উন্নতি
এই ব্রত পালনের মাধ্যমে মা ষষ্ঠীর আশীর্বাদ লাভ হয় এবং মানসিক শান্তি পাওয়া যায়। ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে এই ব্রত পালন করলে আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটে।
বিশেষ সতর্কতা ও নির্দেশনা
তিথির বিশেষত্ব
যদি কোনো কারণে ব্রতের দিনটি সোমবার, মঙ্গলবার, শুক্রবার বা শনিবার পড়ে, তাহলে সেদিন লোটনষষ্ঠীর পূজা করা উচিত নয়। সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র নিয়মাবলী মেনে চলতে হবে।
পুরোহিতের সাহায্য
নিজে অথবা পুরোহিত ডেকে এই পূজা করানো যায়। তবে যারা পূজার নিয়মকানুন ভালো জানেন না, তাদের পুরোহিতের সাহায্য নেওয়াই উত্তম।
আধুনিক যুগে লুণ্ঠনষষ্ঠী ব্রতের প্রাসঙ্গিকতা
আজকের ব্যস্ত জীবনযাত্রায় অনেক মায়েরা সন্তানের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত থাকেন। এই প্রেক্ষাপটে লুণ্ঠনষষ্ঠীর ব্রত শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি মায়েদের মানসিক শক্তি ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে। একদিনের উপবাস ও পূজার মাধ্যমে মা ও সন্তানের মধ্যে এক গভীর আধ্যাত্মিক বন্ধন তৈরি হয়।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি
যদিও এই ব্রতের অলৌকিক ফলাফলের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, তবুও এই ব্রত পালনের মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি ও পারিবারিক সংহতি বৃদ্ধি পায়। উপবাস রাখার ফলে শরীরের বিষাক্ত পদার্থ বের হয়ে যায় এবং মানসিক একাগ্রতা বাড়ে।
লুণ্ঠনষষ্ঠীর ব্রত শুধু একটি পূজা-অর্চনা নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ২০২৫ সালের ৩০ জুলাই এই পবিত্র দিনে যারা সন্তানের মঙ্গল কামনা করে এই ব্রত পালন করবেন, তাদের জীবনে আনন্দ ও শান্তি নেমে আসুক। মা ষষ্ঠীর আশীর্বাদে সকল সন্তান সুস্থ, দীর্ঘায়ু ও সুখী হোক—এই প্রার্থনা করে আজকের লেখা শেষ করছি। আপনিও যদি এই ব্রত পালন করার পরিকল্পনা করেন, তাহলে আপনার অভিজ্ঞতা কমেন্টে শেয়ার করুন এবং অন্যদের সাথে এই তথ্যবহুল লেখাটি ভাগ করে নিন।